সাঁঝের তারা

Any Subtitlejuin 28, 2023

[ad_1]

সাঁঝের তারা

সাঁঝের তারার সাথে যেদিন আমার নতুন করে চেনা-শোনা, সে এক বড়ো মজার ঘটনা।

আরব-সাগরের বেলার ওপরে একটি ছোট্ট পাহাড়। তার বুক রংবেরং-এর শাঁখের হাড়ে ভরা। দেখে মনে হয়, এটা বুঝি একটা শঙ্খ-সমাধি। তাদেরই ওপর একলা পা ছড়িয়ে বসে যে কথা ভাবছিলাম সেকথা কখনও বাজে উদাস পথিকের কাঁপা গলায়, কখনও শুনি প্রিয়-হারা ঘুঘুর উদাস ডাকে; আর ব্যথাহত কবির ভাষায় কখনও কখনও তার আচমকা একটি কথা-হারা কথা – উড়ে-চলা পাখির মিলিয়ে-আসা ডাকের মতো শোনায়।

সেদিন পথ-চলার নিবিড় শ্রান্তি যেন আমার অণু-পরমাণুতে আলস-ছোঁওয়া বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। ঘুমের দেশের রাজকুমারী আমার রুখু চুলের গোছাগুলি তার রজনীগন্ধার কুঁড়ির মতো আঙুল দিয়ে চোখের ওপর হতে তুলে দিতে দিতে বললে, ‘লক্ষ্মীটি এবার ঘুমোও!’ বলেই সে তার বুকের কাছটিতে কোলের উপর আমার ক্লান্ত মাথাটি তুলে নিলে। তার সইদের কণ্ঠে আর বীণায় সুর উঠছিল –

অশ্রু-নদীর সুদূর পারে
ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে।

আমার পরশ-হরষে সদ্য-বিধবার কাঁদনের মতো একটা আহত-ব্যথা টোল খাইয়ে গেল। আমি ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে কণ্ঠ-ভরা মিনতি এনে বললাম, ‘আবার ওইটে গাইতে বলো না ভাই!’ গানের সুরের পিছু পিছু আমার পিপাসিত চিত্ত হাওয়ার পারে কোন্ দিশেহারা উত্তরে ছুটে চলল। তারপর… কেউ কোথাও নেই। একা – একা – শুধু একা! ওগো কোথায় আমার অশ্রু-নদী? কোথায় তার সুদূর পার? কোথায় বা তার ঘাট, আর সে কার দ্বারে? দিকহীন দিগন্ত সারা বিশ্বের অশ্রুর অতলতা নিয়ে আরেক সীমাহারার পানে মৌন ইঙ্গিত করতে লাগল, – ‘ওই – ওই দিকে গো ওই দিকে!’… হায়? কোথায় কোন্ দিকে কে কী ইঙ্গিত করে?

অলস-আঁখির উদাস-চাওয়া আমার সারা অঙ্গে বুলিয়ে মলিন কণ্ঠে কে এসে বিদায়-ডাক দিলে, – ‘পথিক ওঠো! আমার যাওয়ার সময় হয়ে এল।’ আমি ঘুমের দেশের বাদশাজাদির পেশোয়াজ-প্রান্ত দু-হাত দিয়ে মুঠি করে ধরে বললাম, ‘না, না, এখনও তো আমার ওঠবার সময় হয়নি।…কে তুমি ভাই? তোমার সব কিছুতে এত উদাস কান্না ফুটে উঠছে কেন?’ তার গলার আওয়াজ একদম জড়িয়ে গেল। ভেজা কণ্ঠে সে বললে, ‘আমার নাম শ্রান্তি, আজ আমি তোমায় বড্ড নিবিড় করে পেয়েছিলাম।… এখন আমি যাই, তুমি ওঠো! আয় সই ঘুম, ওকে ছেড়ে দে!’

জেগে দেখি, কেউ কোথাও নেই, আমি একা। তখন সাঁঝের রানির কালো ময়ূরপঙ্খি ডিঙিখানা ধূলি-মলিন পাল উড়িয়ে সাগর বুকে নেমেছে। … জানটা কেমন উদাস হয়ে গেল! …যারা আমার সুপ্তির মাঝে এমন করে জড়িয়ে ছিল, তাদের চেতনার মাঝে হারালাম কেন? এই জাগরণের একা-জীবন কী দুর্বিষহ বেদনার ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত, কী নিষ্করুণ শুষ্কতা তিক্ততায় ভরা! সেইদিন বুঝলাম, কত কষ্টে ক্লান্ত পথিকের ব্যর্থ সন্ধ্যা-পথে উদাস পুরবির অলস ক্রন্দন এলিয়ে এলিয়ে গায়–

বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে,
শূন্য ঘাটে একা আমি, পার করে
নাও খেয়ার নেয়ে!

হায় রে উদাসীন পথিক! তোর সব ব্যর্থ ভাই, সব ব্যর্থ! কোথায় খেয়ার নেয়ে ভাই? কোন্ অচিন মাঝিকে এমন বুক-ফাটা ডাক ডাকিস তুই? কোথায় সে? কার পথ চেয়ে তোর বেলা গেল? কে সে তোর জন্ম-জন্ম ধরে চাওয়া না-পাওয়া ধন? কোন্ ঘাটে তুই একা বসে এই সুরের জাল বুনছিস? এ ঘাটে কি কোনোদিন সে তার কলসিটি-কাঁখে চলতে গিয়ে দু-হাতে ঘোমটা ফাঁক করে তোর মুখে চোখে বধূর আধখানা পুলক-চাওয়া থুয়ে গিয়েছিল? নাকি – সে তার কমল-পায়ের জল-ভেজা পদচিহ্ন দিয়ে তোর পথের বুকে স্মৃতির আলপনা কেটে গিয়েছিল? কখনও কাউকে জীবন ভরে পেলি নে বলেই কি তোর এত কষ্ট ভাই? হায় ও-পারের যাত্রী, তোমার সেই ‘কবে-কখন একটুখানি-পাওয়া’ হৃদয়-লক্ষ্মীর চরণ-ছোঁওয়া একটি ধূলি-কণাও আজ তোমার জন্যে পড়ে নেই! বৃথাই সে রেণু-পরিমল পথে পথে খোঁজা ভাই, বৃথা – বৃথা!

অবুঝ মন ওসব কিচ্ছু শুনতে চায় না, বুঝতে চায় না। তার মুখে খ্যাপা মনসুরের একটি কথা ‘আনাল হক’ -এর মতো যুগ-যুগান্তের ওই একই অতৃপ্ত শোর উঠছে, ‘হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! হায় আমার হারানো লক্ষ্মী!’

ঘুমিয়ে বরং থাকি ভালো। তখন যে আমি স্বপনের মাঝে আমার না-পাওয়া লক্ষ্মীকে হাজারবার হাজার রকমে পাই। তাকে এই যে জাগরণের মধ্যে পাওয়ার একটা বিপুল আকাঙ্ক্ষা, – বুকে বুকে মুখে মুখে চেপে নিতে, সেই তার উষ্ণ-পাওয়াকে আমি ঘুমের দেশে স্বপনের বাগিচায় বড়ো নিবিড় করেই পাই। মানুষের মন মস্ত প্রহেলিকা। মন নিক্তির মতোন যখন যেদিকে ভার বেশি পায়, সেই দিকেই নুয়ে পড়ে। তাই কখনও মনে করি পাওয়াটাই বড়ো, পাওয়াতেই সার্থকতা। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, না – না – পাওয়াটাই পাওয়া, ওই না-পাওয়াতেই সকল পাওয়া সুপ্ত রয়েছে। এ সমস্যার আর মীমাংসা হল না। অথচ দুই পথেরই লক্ষ্য এক। দুই স্রোতের লক্ষ্য সাগর-প্রিয়ার সীমাহারা বুকে নিজের সমস্ত বেগ সমস্ত গতি সমস্ত স্রোত একেবারে শেষ করে ঢেলে দেওয়া, তারপর নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া – শুধু এক আর এক! কিন্তু এই ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর’ কথাটার এমন একটা নেশার মাদকতা রয়েছে, যেটা অনবরত আমার মনের কামনা-কিশোরীকে শিউরিয়ে তুলেছে এবং বলেছে, ‘বন্ধনেই মুক্তি’ – এই যে মানব-মনের চিরন্তনী বাণী, সেটা কি মিথ্যা? না, এ সমস্যার সমাধান নেই।

আবার মনটা গুলিয়ে যাচ্ছে।

আমার মনের ভোগ আর বৈরাগ্যের একটা নিষ্পত্তিও হল না আর তাই কাউকে জীবন ভরে পাওয়াও গেল না!

তবে?… …

কাউকে না পেয়েও আমার মনে এ কোন্ আদিম-বিরহী ভুবন-ভরা বিচ্ছেদ-ব্যথায় বুক পুরে মুলুক মুলুকে ছুটে বেড়াচ্ছে? খ্যাপার পরশমণি খোঁজার মতোন আমিও কোন্ পরশমণির ছোঁওয়া পেতে দিকে দিকে দেশে দেশে ঘুরে মরছি? কোন্ লক্ষ্মীর আঁচল প্রান্তে বাঁধা রয়েছে সে মানিক? কোন্ তরুণীর গলায়-রক্ষা-কবচ হয়ে ঝুলছে সে পাথর?

ভাবতে ভাবতে চোখে জল গড়িয়ে এল। সেই জলবিন্দুতে সহসা কার দুষ্টু হাসির চপল কিরণ ছলছলিয়ে উঠল। আমি চমকে সামনে চোখ চাইতেই দেখলাম, আকাশের মুক্ত আঙিনায় ললাটের আধফালি ঘোমটায় ঢেকে প্রদীপ-হাতে সাঁঝের তারা দাঁড়িয়ে। তার চোখের কিনারায়, মুখের রেখায়, অধরপুটের কোণে কোণে দুষ্টুমির হাসি লুকোচুরি খেলছে। বারে বারে উছলে-উঠা নিলাজ হাসি ঠোঁটের কাঁপন দিয়ে লুকোবার ব্যর্থ চেষ্টায় তার হাতে মঙ্গল-প্রদীপ কেঁপে কেঁপে লোলুপ শিখা বাড়িয়ে সুন্দরীর রাঙা গালে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দেওয়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে। পাগল হাওয়া বারেবারে তার বুকের বসন উড়িয়ে দিয়ে বেচারিকে আরও অসংবৃত, আরও বিব্রত করে তুলছে।

অনেকক্ষণ ধরে সেও আমার পানে চেয়ে রইল, আমিও তার পানে চেয়ে রইলাম। আমার কণ্ঠ তখন কথা হারিয়ে ফেলেছে।

সে ক্রমেই অস্তপারের-পথে পিছু হেঁটে যেতে লাগল। তার চোখের চাওয়া ক্রমেই মলিন সজল হয়ে উঠতে লাগল। বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলার দরুণ তার বুকের কাঁচলি বায়ুর মুখে কচিপাতার মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল। যতই সে আকাশ-পথ বেয়ে অস্ত-পল্লির পথে চলতে লাগল ততই তার মুখ-চোখ মূর্ছাতুরের মতোন হলদে ফ্যাকাসে হয়ে যেতে লাগল। তার পর পথের শেষ-বাঁকে দাঁড়িয়ে সে তার শেষ অচপল অনিমেষ চাওয়া চেয়ে আমায় একটি ছোট্ট সেলাম করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হিয়ায় হিয়ায় আমার শুধু একটি কাতর মিনতি মূঢ়ের মতো না-কওয়া ভাষায় ধ্বনিত হচ্ছিল – ‘হায় সন্ধ্যা-লক্ষ্মী আমার, হায়!’

হঠাৎ আমার মনে হল, আমি কত বছর ধরে যে এই রকম করে, রোজ সন্ধ্যা-লক্ষ্মীর পানে চেয়ে চেয়ে আসছি তা কিছুতেই স্মরণ হয় না। শুধু এইটুকু মাত্র মনে পড়ে যে, সে কোন্ যুগে যেন আমি আজিকার মতনই এমনি করে প্রভাতের শুকতারাটির পানে শুধু উদয়-পথে তাকিয়ে থাকতাম। আমার সমস্ত সকাল যেন কোন্ প্রিয়তমার আসার আশায় নিবিড় সুখে ভরে উঠত। রোজ প্রভাতে উদয়-পথে মুঠি-মুঠি করে ফাগ-মাখা ধূলি-রেণু ছড়াতে ছড়াতে সে আসত, তার পর আমার পানে চেয়েই সলজ্জ তৃপ্তির হাসি হেসে যেন বারে বারে আড়-নয়নের বাঁকা চাউনি হেনে বলত ‘ওগো পথ-চাওয়া বন্ধু আমার, আমি এসেছি!’ আমি তার চোখের ভাষা বুঝতে পারতাম, তার চাওয়ার কওয়া শুনতে পেতাম। … তার পর অরুণদেব তাঁর রক্ত-চক্ষু দিয়ে আমাদের পানে চাইলেই সে ভীতা বালিকার মতো ছুটে আকাশ আঙিনা বেয়ে ঊর্ধ্বে – ঊর্ধ্বে – আরো ঊর্ধ্বে উধাও হয়ে যেত। ছুটতে ছুটতেও কত হাসি তার! সারাদিন আমি শুনতে পেতাম তার ওই পালিয়ে যাওয়া পথের বুকে তার কটি-কিঙ্কিণির রিনিরিনি, হাতের পান্নার চুড়ির রিনিঝিনি আর পায়ে গুজরী পাঁইজোরের রুমুঝুমু। … এমন করে দিন যায়। … একদিন আমি বললাম, ‘তুমি কি আমার পথে নেমে আসবে না প্রিয়?’ সে আমার পানে একটু তাকিয়েই সিঁদুরে আমের মতো রেঙে উঠে আধ-ফোটা কথায় কেঁপে কেঁপে বললে, ‘না প্রিয়, আমায় পেতে হলে তোমাকে এই তারার একটি হতে হবে। আমি নেমে যেতে পারি নে, তোমাকে আমার পথেই উঠে আসতে হবে।’ বলবার সময় অনামিকা অঙ্গুলি দিয়ে তার বেনারসী চেলির আঁচল প্রান্ত যেমন সে আনমনে জড়িয়ে যাচ্ছিল, তার চোখের চাওয়া মুখের কথা সেদিন যেন তেমনি করেই অসহ্য ব্যথা-পুলকে জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। বুঝলাম, সে বিশ্বের চিরন্তন ধারাটি বজায় রেখেই আমার সঙ্গে মিলতে চায়। আমার সৃষ্টিছাড়া-পথে বেরিয়ে পড়তে তার কোমল বুক সাহস পাচ্ছে না। যতই ভালোবাসুক না, আমার পথ-হারা পথে চলতে – আমার বিপুল ভার বয়ে সেই অজানা ভয়ের পথে চলতে – সে যেন কিছুতেই পারবে না।

কিন্তু তাই কি?

হয়তো তা ভুল। কেননা একদিন যেন সে বলেছিল, ‘প্রিয়তম, এ যে তোমার ভুলের পথ, এ পথ তো মঙ্গলের নয়। আঘাত দিয়ে তোমায় এ পথ হতে ফিরাতেই হবে। তোমায় কল্যাণের পথে না আনতে পারলে তো আমি তোমার লক্ষ্মী হতে পারি নে!’ সেকথা যেন আজকের নয়, কোন্ অজানা নিশীথে আমি ঘুমের কানে শুনেছিলাম। তখন তা কিন্তু বুঝতে পারিনি।

আমি যেমন কিছুতেই তার চিরন্তন ধারাটির একগুঁয়েমি সইতে পারলাম না, সেও তেমনই নীচে নেমে আমার পথে এল না।

বিদায় নেওয়ার দিনও সে তেমনি করে হেসে গেছে। তেমনি করেই তার দুষ্ট চটুল চাউনি দিয়ে সে আমায় বারেবারে মিষ্টি বিদ্রুপ করেছে। শুধু একটি নতুন কথা শুনিয়ে গেছল, ‘আর এ পথে আমাদের দেখা হবে না প্রিয়, এবার নতুন করে নতুন পথে নতুন পরিচয় নিয়ে আমরা আমাদের পূর্ণ করে চিনব।’

তার বিদায়-বেলায় যে দীঘল শ্বাসটি শুনেও শুনিনি, আজ আমি সারা বাতাসে যেন সেই ব্যথিত কাঁপুনিটুকু অনুভব করছি। এখন সে বাতাস নিতেও কষ্ট হয়। … কবে আমার এ নিশ্বাস-প্রশ্বাসে-টেনে-নেওয়া বায়ুর আয়ু চিরদিনের মতো ফুরিয়ে যাবে প্রিয়? … তার বিদায়-চাওয়া যে ভেজা-দৃষ্টিটুকু আমি দেখেও দেখিনি, আজ সারা আকাশের কোটি কোটি তারার চোখের পাতায় সেই অশ্রুকণাই দেখতে পাচ্ছি! এখন তারা হাসলেও মনে হয়, ও শুধু কান্না আর কান্না!

তারপর রোজ আসি রোজ যাই, কিন্তু উদার-পথে আর তার রাঙা চরণের আলতার আলপনা ফুটল না! এখন অরুণ রবি আসে হাসতে হাসতে। তার সে হাসি আমার অসহ্য। পাখির কণ্ঠের বিভাস সুর আমার কানে যেন পুরবির মতো করুণ হয়ে বাজে।…

আমি বললাম, ‘হায় প্রিয়তম, তোমায় আমি হারিয়েছি!’ দেখলাম, আকাশ-বাতাস আমার সে কান্নায় যোগ দিয়ে বলছে, ‘তোমায় হারিয়েছি!’ তখন সন্ধ্যা – ওই সিন্ধুবেলায়।

হঠাৎ ও কার চেনা-কণ্ঠ শুনি? ও কার চেনা-চাওয়া দেখি? ও কে রে, কে?

বললাম, ‘আজ এ বধূর বেশে কোথায় তুমি প্রিয়?’ সে বললে, ‘অস্ত-পথে!’

সে আরও বলে গেছে যে, সে রোজই তার ম্লানমূর্তি নিয়ে এই অস্ত-গাঁয়ের আকাশ-আঙিনায় সন্ধ্যা-প্রদীপ দেখাতে আসবে। আমি যেন আর তার দৃষ্টির সীমানায় না আসি।

বুঝলাম সে যতদিন অস্ত-পারের দেশে বধূ হয়ে থাকবে, ততদিন তার দিকে তাকাবারও আমার অধিকার নেই। আজও সে তার জগতের সেই চিরন্তন সহজ ধারাটুকুকে বজায় রেখে চলছে। সে তো বিদ্রোহী হতে পারে না। সে যে নারী – কল্যাণী। সে-ই না বিশ্বকে সহজ করে রেখেছে, তার অনন্ত ধারাটিকে অক্ষুণ্ন সামঞ্জস্য দিয়ে ঘিরে রেখেছে।

শুধোলাম, ‘আবার কবে দেখা হবে তবে? আবার কখন পাব তোমায়?’ সে বললে, ‘প্রভাত বেলায় ওই উদয়-পথেই।’

আজ সে বধূ, তাই তার সাঁঝের-পথে আর তাকাইনি।

জানিনে, কবে কোন্ উদয়-পথে কোন্ নিশিভোরে কেমন করে আমাদের আবার দেখাশোনা হবে। তবু আমার আজও আশা আছে, দেখা হবেই, তাকে পাবই!

*  *  *

সিন্ধু পেরিয়ে ঘরের আঙিনায় যখন একা এসে ক্লান্ত চরণে দাঁড়ালাম, তখন ভাবিজি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাঁ ভাই, তুমি নাকি বে করেছ?’ আমি মলিন হাসি হেসে বললাম ‘হাঁ।’ তিনি হেসে শুধোলেন, ‘তা বেশ করেছ। বধু কোথায়? নাম কী তার?’

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইলাম। শ্রী-রাগের সুরে সুর-মূর্ছিতা মলিনা সন্ধ্যার ঘোমটায় কালো আবছায়া যেন সিয়াহ্ কাফনের মতো পশ্চিম-মুখী ধরণির মুখ ঢেকে ফেলতে লাগল। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

তারপর অতিকষ্টে ওই পশ্চিম-পারের পানে আঙুল বাড়িয়ে বললাম, ‘অস্তপারের সন্ধ্যা-লক্ষ্মী!’

ভাবিজানের ডাগর আঁখিপল্লব সিক্ত হয়ে উঠল; দৃষ্টিটুকু অব্যক্ত ব্যথায় নত হয়ে এল। কালো সন্ধ্যা নিবিড় হয়ে নেমে এল।

laissez un commentaire

prénom *
Ajouter un nom d'affichage
Email *
Votre adresse email ne sera pas publiée

Ce site utilise Akismet pour réduire les indésirables. En savoir plus sur comment les données de vos commentaires sont utilisées.

fr_FRFrançais