ধর্মঘট

Any SubtitleJuni 29, 2023

[ad_1]

ধর্মঘট

দেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘যে এলো চষে সে রইল বসে, নাড়া-কাটাকে ভাত দাও এক থালা কষে।’ হূলের দংশন-জ্বালা যথেষ্ট থাকলেও কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। স্বয়ং ‘নাড়া-কাটা’ প্রভুরাও এ-কথাটা ভালো করিয়াই বুঝেন, কিন্তু বুঝিয়াও যে না বুঝিবার ভান করেন বা প্রতিকারের জন্য নিজেদের দারাজ-দস্ত সামলান না, ইহা দেখিয়া বাস্তবিকই আমাদের মনুষ্যত্বে, বিবেক আঘাত লাগে এবং তাহারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-পতাকা তুলিলেই হইল ‘ধর্মঘট’। চাষি সমস্ত বৎসর হাড়-ভাঙা মেহনত করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়াও দু-বেলা পেট ভরিয়া মাড়ভাত খাইতে পায় না, হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা তেনা বা নেঙট ছাড়া তাহার আর ভালো কাপড় পিরান পরা সারা-জীবনেও ঘুটিয়া উঠে না, ছেলেমেয়ের সাধ-আরমান মিটাইতে পায় না, অথচ তাহারই ধান-চাল লইয়া মহাজনরা পায়ের উপর পা দিয়া বারোমাস তেত্রিশ পার্বণ করিয়া নওয়াবি চালে দিন কাটাইয়া দেন। কয়লার খনির কুলিদিগকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, তাহাদের কেহ ত্রিশ-চল্লিশ বৎসরের বেশি বাঁচে না; তাহারা দিবারাত্রি খনির নীচে পাতালপুরীতে আলো-বাতাস হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়া কয়লার গাদায় কেরোসিনের ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করিয়া শরীর মাটি করিয়া ফেলে। কোম্পানি তো তাহাদেরই দৌলতে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিতেছেন, কিন্তু এ-হতভাগ্যদের স্বাস্থ্য, আহার প্রভৃতির দিকে ভুলিয়াও চাইবেন না। এই কুলিদিগের চেহারার দিকে তাকাইয়া কেহ কখনও চিনিতে পারিবেন না যে, ইহারা মানুষ কী প্রেত-লোক-ফেরতা বীভৎস নর-কঙ্কাল। দোষ কাহাদের? কর্তাদের মতে দোষ অবশ্য এই হতভাগাদেরই। কারণ পেট বড়ো ‘মুদ্দই’ এবং পেটের জন্যই ইহারা এমন করিয়া আত্মহত্যা করে।

আমরা মাত্র এই দুই-একটি নজির দিয়াই ক্ষান্ত হইলাম। দেশের সমস্ত কল-কারখানায়, আড়তে গুদামে ‘ভাবিয়া চিন্তিয়া মানুষ হত্যার’ এইরূপ শত শত বীভৎস নগ্নতা দেখিতে পাইবেন। আমাদের ক্ষমতা নাই যে, তাহা ভাষায় বর্ণনা করিয়া বলি। যাঁহারা ওইসব কলকারখানায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে এতটুকুও সংশ্লিষ্ট আছেন, বা একদিনের জন্যও ওদিক মাড়াইয়াছেন তাঁহারাই আমাদের এই বর্ণনার চেয়ে এর সত্যতা কতগুণ বেশি বুঝিতে পারিবেন। আজকাল বিশ্ব-মানবের মধ্যে larger humanity বলিয়া যে একটা মহত্তর মানবতার স্বর্গীয় ভাব জাগিয়াছে, এই কলকারখানার অধিকাংশ কর্তা বা কর্তৃপক্ষেরই সে-দিকটা যেন একেবারে পাষাণ হইয়া গিয়াছে। তাঁহাদের চোখের সামনে রাত্রিদিন মনুষ্যত্ব-বিবর্জিত কত অমানুষিক পাশবতা তাহাদেরই এইসব কারখানায় আড়তে অনুষ্ঠিত হইতেছে, কিন্তু তাঁহারা নির্বাক নিশ্চল! নিজেরা ‘মজাসে’ আকণ্ঠ ভোগের মধ্যে থাকিয়া কুলি-মজুরদের আবেদন-নিবেদনকে বুটের ঠোক্কর লাগাইতেছেন। সবারই অন্তরে একটা বিদ্রোহের ভাব আত্ম-সম্মানের স্থূল সংস্করণরূপে নিদ্রিত থাকে, যেটা খোঁচা খাইয়া খাইয়া জর্জরিত না হইলে মরণ-কামড় কামড়াইতে আসে না। কিন্তু ইহাতে এই মনুষ্যত্ববিহীন ভোগবিলাসী কর্তার দল ভয়ানক রুষ্ট হইয়া উঠেন, তাঁহারা তখনও বুঝিতে পারেন না যে, এ অভাগাদের বেদনার বোঝা নেহাত অসহ্য হওয়াতেই তাহাদের এ-বিদ্রোহের মাথা ঝাঁকানি। উন্নত আমেরিকা-ইউরোপেই ইহার প্রথম প্রচলন। সেখানে এখন লোকমতের উপরই শাসন প্রতিষ্ঠিত, এই গণতন্ত্র বা ডিমোক্র্যাসিই সেদেশে সর্বেসর্বা; তাই শ্রমজীবীদলেরও ক্ষমতা সেখানে অসীম। তাহারা যেরকম মজুরি পায়, তাহাদের স্বাস্থ্য-শিক্ষা আহার বিহার প্রভৃতির যে রকম সুখ-সুবিধা, তাহার তুলনায় আমাদের দেশের শ্রমজীবীগণের অবস্থা কশাইখানার পশু অপেক্ষাও নিকৃষ্ট। তাই এতদিন নির্বিচারে মৌন থাকিয়া মাথা পাতিয়া সমস্ত অত্যাচার-অবিচার সহিয়া সহিয়া শেষে যখন আজ রক্তমাংসে শরীরে তাহা একেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল, তখন তাহারাও মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল। এই বুরোক্র্যাসি বা আমলাতন্ত্র-শাসিত দেশেও তাহারা যখন তাহাদের দুঃখ-কষ্ট-জর্জরিত ছিন্নভিন্ন অন্তরের এমন বিদ্রোহ-ধ্বজা তুলিল, তখন যাঁহার অন্তঃকরণ বা Sentiment বলিয়া জিনিস আছে, তিনিই বুঝিতে পারিবেন, ইহাদের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগ কত বেশি অসহনীয় তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। এই ধর্মঘটের আগুন এখন দাউদাউ করিয়া সারা ভারতময় জ্বলিয়া উঠিয়াছে এবং ইহা সহজে নিভিবার নয়, কেননা ভারতেও এই পতিত উপেক্ষিত নিপীড়িত হতভাগাদের জন্য কাঁদিবার লোক জন্মিয়াছে, এদেশেও মহত্তর মানবতার অনুভব সকলেই করিতেছেন। সুতরাং শ্রমজীবী দলেও সেই সঙ্গে তথাকথিত গণতন্ত্র ও ডিমোক্র্যাসির জাগরণও এ-দেশে দাবানলের মতো ছড়াইয়া পড়িতেছে এবং পড়িবে কেহই উহাকে রুখিতে পারিবে না। পশ্চিম হইতে পূর্বে ক্রমেই ইহা বিস্তৃতি লাভ করিতেছে এবং করিবে। এ ধর্মঘট ক্লিষ্ট মুমূর্ষ জাতের শেষ কামড়, ইহা বিদ্রোহ নয়।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

Situs ini menggunakan Akismet untuk mengurangi spam. Pelajari bagaimana data komentar Anda diproses.

id_IDBahasa Indonesia