বাউন্ডেলের আত্মকাহিনি

Any Subtitlejunio 28, 2023

[ad_1]

বাউন্ডেলের আত্মকাহিনি

[ ক ]

[বাঙালি পলটনের একটি বওয়াটে যুবক আমার কাছে তাহার কাহিনি বলিয়াছিল নেশার ঝোঁকে : নীচে তাহাই লেখা হইল। সে বোগদাদে গিয়া মারা পড়ে –]

“কি ভায়া! নিতান্তই ছাড়বে না? একদম এঁটেল মাটির মতো লেগে থাকবে? আরে ছোঃ! তুমি যে দেখছি চিটে গুড়ের চেয়েও চামচিটেল! তুমি যদিও হচ্ছ আমার এক ক্লাসের ইয়ার, তবুও সত্যি বলতে কি, আমার সে সব কথাগুলো বলতে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হয়। কারণ খোদা আমায় পয়দা করবার সময় মস্ত একটা গলদ করে বসেছিলেন, কেননা চামড়াটা আমার করে দিলেন হাতির চেয়েও পুরু, আর প্রাণটা করে দিলেন কাদার চেয়েও নরম! আর কাজেই দু-চার জন মজুর লাগিয়ে আমার এই চামড়ায় মুগুর বসালেও আমি গোঁপে তা দিয়ে বলব, ‘কুচ্ পরওয়া নেই’, কিন্তু আমার এই ‘নাজোক’ জানটায় একটু আঁচড় লাগলেই ছোট্ট মেয়ের মতো চেঁচিয়ে উঠবে! তোমার ‘বিরাশি দশআনা’ ওজনের কিলগুলো আমার এই স্থূল চর্মে স্রেফ আরাম দেওয়া ভিন্ন আর কোনো ফলোৎপাদন করতে পারে না, কিন্তু যখনই পাকড়ে বস, ‘ভাই, তোমার সকল কথা খুলে বলতে হবে,’ তখন আমার অন্তরাত্মা ধুকধুক করে ওঠে, – পৃথিবী ঘোরার ভৌগোলিক সত্যটা তখন হাড়ে হাড়ে অনুভব করি। চক্ষেও যে সর্ষপ পুষ্প প্রস্ফুটিত হতে পারে বা জোনাক পোকা জ্বলে উঠতে পারে, তা আমার মতো এই রকম শোচনীয় অবস্থায় পড়লে তুমিও অস্বীকার করবে না।

 

[ খ ]

‘হাঁ আমার ছোটোকালের কোনো কথা বিশেষ ইয়াদ হয় না। আর আবছায়া রকমের একটু একটু মনে পড়লেও তাতে তেমন কোনো রস বা রোমান্স (বৈচিত্র্য) নেই! – সেই সরকারি রামশ্যামের মতো পিতামাতার অত্যধিক স্নেহ, পড়ালেখায় নবডঙ্কা, ঝুলঝাপপুর ডান্ডাগুলি খেলায় ‘দ্বিতীয় নাস্তি’, ‘দুষ্টামি-নষ্টামিতে নন্দদুলাল কৃষ্ণের তদানীন্তন অবতার, আর ছেলেদের দলে অপ্রতিহত প্রভাবে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ! আমার অনুগ্রহে ও নিগ্রহে গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বিশেষ খোশ ছিলেন কিনা, তা আমি কারুর মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি না; তবে সকলেই আমার পরমার্থ কল্যাণের জন্য যে সকাল-সন্ধে প্রার্থনা করত সেটা আমার তীক্ষ্ণ শ্রবণেন্দ্রিয় না-ওয়াকেফ ছিল না। একটা প্রবাদ আছে, ‘উৎপাত করলেই চিৎপাত হতে হয়’। সুতরাং এটা বলাই বাহুল্য যে, আমার পক্ষেও উক্ত মহাবাক্যটির ব্যতিক্রম হয়নি, বরং ও কথাটা ভয়ানকভাবেই আমার উপর খেটেছিল; কারণ ঘটনাচক্রে যখন আমি আমার জননীর কক্ষচ্যুত হয়ে সংসারের কর্মবহুল ফুটপাতে চিৎপাত হয়ে পপাত হলুম, তখন কত শত কর্মব্যস্ত সবুট-ঠাং যে অহম-বেচারার ব্যথিত পাঁজরের উপর ‍দিয়ে চলে গেল, তার হিসেব রাখতে শুভঙ্কর দাদাও হার মেনে যায়। – থাক আমার সে সব নীরস কথা আউড়িয়ে তোমার আর পিত্তি জ্বালাব না। শুনবে মজা?

একদিন পাঠশালায় বসে আমি বঙ্কিমবাবুর মুচিরাম গুড়ের অনুকরণে ছেলেদের মজলিস সরগরম করে আবৃত্তি করছিলুম, ‘মানময়ী রাধে! একবার বদন তুলে গুড়ুক খাও!’ এতে শ্রীমতী রাধার মানভঞ্জন হয়েছিল কিনা জানবার অবসর পাইনি, কারণ নেপথ্যে ভুজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে ‘আরে রে, দুর্বৃত্ত পামর’ বলে হুংকার করে আমার ঘাড়ে এসে পড়লেন সশরীরে আমাদের আর্কমার্কা পণ্ডিতমশাই! যবনিকার অন্তরালে যে যাত্রার দলের ভীম মশাইয়ের মতো ভীষণ পণ্ডিতমশাই অবস্থান করছিলেন, এ নাবালকের একেবারেই জানা ছিল না। – তাঁর ক্রোধবহ্নি যে দুর্বাসার চেয়েও উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল তা আমি বিশেষ রকম উপলব্ধি করলুম তখন, যখন তিনি একটা প্রকাণ্ড মেষের মতো এসে আমার নাতিদীর্ঘ শ্রবণেন্দ্রিয় দুটি ধরে দেয়ালের সঙ্গে মাথাটার বিষম সংঘর্ষণ আরম্ভ করলেন। তখনকার পুরোদস্তুর সংঘর্ষণের ফলে কোনো নূতন বৈদ্যুতিক ক্রিয়ার উদ্ভাবন হয়নি সত্য, কিন্তু আমার সর্ব শরীরের ‘ইলেকট্রিসিটি’ যে সাংঘাতিক রকম ছুটাছুটি করেছিল, সেটা অস্বীকার করতে পারব না। মার খেয়ে খেয়ে ইটপাটকেলের মতো আমার এই শক্ত শরীরটা যত না কষ্ট অনুভব করেছিল, তাঁর সালংকার গালাগালির তোড়ে তার চেয়ে অনেক কষ্ট অনুভব করেছিল আমার মনটা। আদৌ মুখরোচক নয় এরূপ কতকগুলো অখাদ্য তিনি আমার পিতৃপুরুষের মুখে দিচ্ছিলেন, এবং একেবারেই সম্ভব নয় এরূপ কতকগুলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দাবি আমার কাছে করেছিলেন। তাঁর পাঁচপুয়া পরিমিত চৈতন্য চুটকিটা ভেকছানাসম শিরোপরি অস্বাভাবিক রকমের লম্ফ-ঝম্প প্রদান করছিল। সঙ্গে সঙ্গে খুব হাসিও পাচ্ছিল, কারণ ‘চৈতন্য তেড়ে উঠার’ নিগূঢ় অর্থ সেদিন আমি সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করেছিলুম! ক্রমে যখন দেখলুম, তাঁর এ প্রহারের কবিতায় আদৌ যতি বা বিরামের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, তখন আর বরদাস্ত হল না! জান তো, ‘পুরুষের রাগ আনাগোনা করে’ আমিও তাই, ওইখানেই একটা হেস্তনেস্ত করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে তার খাঁড়ার মতো নাকটায় বেশ মাঝারি গোছের একটা ঘুঁষি বাগিয়ে দিয়ে বীরের মতো সটান স্বগৃহাভিমুখে হাওয়া দিলুম। বাড়ি গিয়েও আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করলুম না। তাই পিতৃভয়ে সেঁদুলুম গিয়ে একেবারে চালের মরাই-এ; উদ্দেশ্য, নিভৃত স্থান হতে কেউ আর সহজে আবিষ্কার করতে পারবেন না – কি জানি কখন কি হয়! খানিক পরে – আমার সেই গুপ্তপুর হতেই শুনতে পেলুম পণ্ডিতমশাই ততক্ষণে সালংকারে আমার জন্মদাতার কাছে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা করে বুঝাচ্ছিলেন যে, আমার মতো দুর্ধর্ষ বাউন্ডেলে ছোকরার লেখা-পড়া তো ‘ক’ অক্ষর গোমাংস, তদুপরি গুরুমশাইয়ের নাসিকায় গুরুপ্রহার ও গুরুপত্নীর নিন্দাবাদ অপরাধে আপাতত এই দুনিয়াতেই আমাকে লোখুঠুঁটোর মতো চাটু হস্তে মাছি মারতে হবে, অর্থাৎ কুষ্ঠব্যাধি হবে, তারপর নরকে যাতে আমার ‘স্পেশাল (বিশেষ) শাস্তির বন্দোবস্ত হয়, তার জন্যেও নাকি তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে ঠিকঠাক করতে পারেন! প্রথমত অভিশাপটার ভয়ে একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলুম। গুরুপত্নীর নিন্দাবাদ কথাটা আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে অবগত হলুম, পণ্ডিতমশাইয়ের অর্ধাঙ্গিনীর নামও নাকি শ্রীমতী রাধা, – আর তাঁর এক-আধটু গুড়ুক খাওয়ার নাকি অভ্যাস আছে, অবিশ্যি সেটা স্বামী দেবতার অগোচরেই সম্পন্ন হয়, আমি নাকি তাই দেখে এসে ছেলেদের কাছে স্বহস্তে গুড়ুক সেজে অভিমানিনী শ্রীমতী রাধার মানভঞ্জনার্থ করুণ মর্মস্পর্শী সুরে উপরোধ করছিলুম, – ‘মানময়ী রাধে, একবার বদন তুলে গুড়ুক খাও’ – আর পণ্ডিতমশাই অন্তরালে থেকে সব শুনছিলেন। – আমার আর বরদাস্ত হল না চালের মরাই-এ থেকেই উশখুশ করতে লাগলুম, ইতিমধ্যে গরমেও আমি রীতিমত গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিলুম। আমি মোটেই জানতুম না পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নির নাম শ্রীমতী রাধা – আর তিনি যে গুড়ুক খান, তা তো বিলকুলই জানতুম না। কাজেই এতগুলো সত্যের অপলাপে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারলুম না, তুড়ুক করে চালের মরাই হতে পিতৃসমীপে লাফিয়ে পড়ে, আমার নির্দোষিতা প্রমাণ করবার জন্যে অশ্রু গদগদ-কণ্ঠে অকাট্য যুক্তি প্রমাণ প্রয়োগ করতে লাগলুম, কিন্তু ততক্ষণে ক্রোধান্ধ পিতা আমার আপিল অগ্রাহ্য করে ঘোড়ার গোগালচির মতো আমার সামনের লম্বা চুলগুলো ধরে দমাদ্দম প্রহার জুড়ে দিলেন। বাস্তবিক, সে রকম প্রহার আমি জীবনে আশা করিনি। – চপেটাঘাত, মুষ্ট্যাঘাত, পদাঘাত ইত্যাদি চার হাত-পায়ের যত রকম আঘাত আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে, সব যেন রবিবাবুর গানের ভাষায় ‘শ্রাবণের ধারার মতো’ পড়তে লাগল আমার মুখের পরে – পিঠের পরে। সেদিনকার পিটুনি খেয়ে আমার পৃষ্ঠদেশ বেশ বুঝতে পেরেছিল যে, তার ‘পিঠ’ নাম সার্থক হয়েছে! একেই আমাদের ভাষায় বলে, ‘পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেওয়া’। বৃন্দাবন না দেখি তার পরদিনই কিন্তু বাবা আমায় বর্ধমান এনে ‘নিউ স্কুলে’ ভরতি করে দিলেন! কী করি, আমি নাচারের মতো সব সহ্য করতে লাগলুম। – কথায় বলে, ‘ধরে মারে, না সয় ভালো’।

 

[ গ ]

“প্রথম প্রথম শহরে এসে আমার মতো পাড়াগেঁয়ে গোঁয়ারকে বিষম বিব্রত হয়ে উঠতে হয়েছিল, বিশেষ করে শহুরে ছোকরাদের দৌরাত্মিতে। সে ব্যাটারা পাড়াগেঁয়ে ছেলেগুলোকে যেন ইঁদুর-প্যাঁচার মতো পেয়ে বসে। যা হোক, অল্পদিনেই আমি শহুরে কায়দায় কেতা-দুরস্ত হয়ে উঠলুম। ক্রমে ‘অহম’ পাড়া-গেঁয়ে ভূতই আবার তাদের দলের একজন হুমরো-চুমরো ওস্তাদ ছোকরা হয়ে পড়ল। সেই – আগেকার পগেয়া – খচ্চর ছেলেগুলোই এখন আমায় বেশ একটু সমীহ করে চলতে লাগল। – বাবা, এ শর্মার কাছে বেঁড়ে-ওস্তাদি, এ ছেলে হচ্ছে অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি। দেখতে দেখতে পড়ালেখায় যত না উন্নতি করলুম, তার চেয়ে বহুল পরিমাণে উন্নতি করলুম রাজ্যের যত দুষ্টোমির গবেষণায়। তখন আমায় দেখলে বর্ধমানের মতো পবিত্র স্থানও তটস্থ হয়ে উঠত। ক্রমে আমাদের মস্ত একটা দল পেকে উঠল। পুলিশের ঘাড়ে দিনকতক এগারো-ইঞ্চি ঝাড়তেই তারা আমাদের সঙ্গে গুপ্ত সন্ধি করে ফেললে। এইরূপে ক্রমেই আমি নিচু দিকে গড়িয়ে যেতে লাগলুম – তাই বলে যে আমাদের দিয়ে কোনো ভালো কাজ হয়নি, তা বলতে পারব না। মিশন, কুষ্ঠরোগ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতিতে আমাদের এই বওয়াটে ছেলের দল যা করেছে তার শতাংশের একাংশও করে উঠতে পারেনি ওই গোবেচারা নিরীহ ছাত্রের দল। তারা আমাদের মতো অমন অদম্য উৎসাহ-ক্ষমতা পাবে কোথায়? তারা তো শুধু বই-এর পোকা। বর্ধমান যখন ডুবে যায়, তখন আমরাই শহরের সিকি লোককে বাঁচিয়েছিলুম, সে সময়ে আমাদের দলের অনেকে নিজের জীবন উৎসর্গ করে, আর্তের জীবন রক্ষা করেছিল। কনফারেন্সের, সভাসমিতির চাঁদা আদায়ের প্রধান উদ্যোগ আয়োজনের প্রধান পাণ্ডা ছিলুম আমরা। আমাদেরই চেষ্টায় ‘স্পোর্টস’, ‘জিমনাস্টিক’, ‘সার্কাস’, থিয়েটার, ক্লাব প্রভৃতির আড্ডাগুলোর অস্তিত্ব অনেকদিন ধরে লোপ পায়নি।

পিতার অবস্থা খুব সচ্ছল না হলেও মাসোহারাটা ঠিক রকমেই পাঠাতেন। তিনি তো আর আমার এতদূর উন্নতির আশা করেননি, আর এত খবরও রাখতেন না। কারণ কোনো ক্লাশে আমার ‘প্রমোশন’ স্টপ হয়নি। বহু গবেষণার ফলেও হেড মাস্টার মহাশয় আবিষ্কার করতে পারেনি – আমার মতো বওয়াটে ছোকরা কী করে পাসের নম্বর রাখে। ভায়া ওইখানেই তো genius-এর (প্রতিভার) পরিচয়! – ‘চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা।’ পরীক্ষার সময় চার-পাঁচজোড়া অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি আমার পেছনে লেগে থাকতই, কিন্তু ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর যার কূল-কিনারা পান না, তাকে ধরবেন ‘পদীর ভাই গৌরীশংকর’। তাছাড়া খালি চুরি বিদ্যায় কি চলে? এতে অনেক মাথা ঘামাতে হয়। পরীক্ষকের ঘর হতে তাঁর ছেলে বা অন্য কোনো ক্ষুদ্র আত্মীয়ের থ্রু দিয়ে রজত চক্রের বিনিময়ে খাতাটি বেমালুম বদলে ফেলা, প্রেস হতে প্রশ্ন চুরি, প্রভৃতি অনেক বুদ্ধিই এ শর্মার আয়ত্ত ছিল। সে-সব শুনলে তোমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠবে। – যা হোক, এই রকমেই ‘যেন তেন প্রকারেণ’ থার্ড ক্লাসের চৌকাঠে পা দিলুম গিয়ে।

বাড়ি খুব কম যেতুম, কারণ পাড়াগাঁ তখন আর ভালো লাগত না। পিতাও বাড়ি না গেলে দুঃখিত হতেন না, কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল, আমি এইবার একটা কিছু না হয়ে যাই না। আমাদের গ্রামের কুল্লে আমিই পড়তে এসেছিলুম ইংরেজি স্কুলে, তার উপর আমি নাকি পাসগুলো পঙ্খিরাজ ঘোড়ার মতো তড়াত্তর ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছিলুম! কেবল একজনের আঁখি দুটি সর্বদাই আমার পথ পানে চেয়ে থাকত, তিনি আমার স্নেহময়ী জননী। মায়ের মন তো এত শত বোঝে না, তাই দু-মাস বাড়ি না গেলেই মা কেঁদে আকুল হতেন। সংসারে মার কাছ ভিন্ন আর কারুর কাছে একটু স্নেহ-আদর পাইনি! দুষ্ট বদমায়েস ছেলে বলে, আমায় যখন সকলেই মারত, ধমকাত, তখন মা-ই কেবল আমায় বুকে করে সান্ত্বনা দিতেন। আমার এই দুষ্টোমিটাই যেন তাঁর সবচেয়ে ভালো লাগত। আমার পিঠে প্রহারের দাগগুলোয় তেল মালিশ করে দিতে দিতে কতদিন তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রুর নদী বয়ে গেছে।

যখন থার্ড ক্লাসে উঠলুম, তখন বোধ হয় মায়ের জিদেই বাবা আমায় চতুষ্পদ করে ফেললেন, অর্থাৎ বিয়ে দিয়ে দিলেন। আমি ‘কটিদেশ বন্ধনপূর্বক’ নানা ওজর আপত্তি দেখাতে লাগলুম, কিন্তু মায়ের আদালতে ও তাঁর অশ্রুজলের ওকালতিতে আমার সমস্ত ওজর বাতিল ও নামঞ্জুর হয়ে গেল। কী করি, যখন শুভদৃষ্টি হয়ে গেল, তখন তো আর কথাই নাই। তাছাড়া, কনেটি মন্দ ছিল না, আজকালকার বাজারে পাড়াগাঁয়ে এরকম কনে শয়ে একটি মেলে না। বয়সও বারো-তেরো হয়েছিল। ওই বারো-তেরো বছরের কিশোরীটিকেই মা নাকি সোমত্থ মেয়ে দেখে বউ করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। আমারও বয়স তখন উনিশের কাছাকাছি। এতেই নাকি মেয়েমহলে মাকে কত কথা শুনতে হত। প্রথম কনে বউ একটি পুটুঁলির মতো জড়সড়ো হয়ে তার নির্দিষ্ট একটি কোণে চুপ করে বসে থাকত। নববধূদের নাকি চোখ তেড়ে চাইতে নেই, তাই সে প্রায়ই চোখ বুঁজে থাকত। কিন্তু অনবরত চোখ বুঁজে থাকা, সেও যে এক বীভৎস ব্যাপার, তাই সে দু-একবার অন্যের অলক্ষ্যে ভয়-চকিত দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে নিত, যদি তার এই বেহায়াপনা কেউ দেখে ফেলে, তা হলেই মহাভারত অশুদ্ধ আর কি! আমাকে দেখলে তো আর কথাই নেই, নিজেকে কাছিমের মতো তৎক্ষণাৎ শাড়ি ওড়না প্রভৃতির ভিতর ছাপিয়ে ফেলত। তখন একজন প্রকাণ্ড অনুসন্ধিৎসু লোকের পক্ষেও বলা দুঃসাধ্য হয়ে উঠত, ওটা মানুষ, না কাপড়ের একটা বোঁচকা। তবে এটা আমার দৃষ্টি এড়াত না যে, আমি অন্যদিকে চাইলেই সে তার বেনারসি শাড়ির ভিতর থেকে চুরি করে আমার দিকে চেয়ে দেখত, কিন্তু আমি তার দিকে চাইতে না চাইতেই সে সটান চোখ দুটোকে বুঁজে ফেলে গম্ভীর হয়ে বসে থাকত, যেন আমায় দেখবার তার আদৌ গরজ নাই। আমি মুখ টিপে হাসতে হাসতে পালিয়ে এসে উচ্চৈঃস্বরে বউয়ের লজ্জাহীনতার কথা প্রকাশ করে ফেলতুম। মা তো হেসেই অস্থির। বলতেন, হ্যাঁরে, তুই কি জনমভর এই রকম খ্যাপাই থাকবি? আমার ভগ্নিগুলি কিন্তু কিছুতেই ছাড়বার পাত্রী নন, তাঁরা বউ-এর রীতিমতো কৈফিয়ত তলব করতেন। সে বেচারির তখনকার বিপদটা ভেবে আমার খুব আমোদ হত, আমি হেসে লুটোপুটি যেতুম। যাহোক, এ একটা খেলা মন্দ লাগছিল না। ক্রমে আমি বুঝতে পারলুম, কিশোরী কনে আমায় ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে। আমি কিন্তু পারতপক্ষে তাকে জ্বালাতন করতে ছাড়তুম না। আমার পাগলামির ভয়ে সে বেচারি আমার সঙ্গে চোখাচোখি চাইতে পারত না, কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে সে যে আমার পানে তার পটলচেরা চোখ দুটির ভাসা-ভাসা করুণ দৃষ্টি দিয়ে হাজারবার চেয়ে দেখত, তা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারতুম, আর গুন গুন স্বরে গান ধরে দিতুম –

‘সে যে করুণা জাগায় সকরুণ নয়ানে,
কেন, কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।’

ক্রমে আমারও ভালোবাসা এই ছেলেমির মধ্যে দিয়ে এক-আধটু করে বেরিয়ে পড়তে লাগল। তারপর পরীক্ষা নিকট দেখে শুভাকাঙ্ক্ষী পিতা আমার আর বাড়িতে থাকা নিরাপদ বিবেচনা করলেন না। আমি চলে আসার দিনে আর জ্যাঠামি দিয়ে হৃদয় লুকিয়ে রাখতে পারিনি। হাসতে গিয়ে অশ্রুজলে গণ্ডস্থল প্লাবিত করেছিলুম। সজল নয়নে তার হাত দুটি ধরে বলেছিলুম, ‘আমার সকল দুষ্টোমি ক্ষমা করো লক্ষ্মীটি, আমায় মনে রেখো।’ সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলে না, কিন্তু তার ওই চোখের জলই যে বলে দিলে সে আমায় কত ভালোবেসে ফেলেছে। আমি ছেড়ে দেওয়ার পর সে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে অব্যক্ত স্বরে কাঁদতে লাগল। আমি চোখে রুমাল চেপে কোনো রকমে নিজের দুর্বলতাকে সংবরণ করে ফেললুম। কে জানত, আমার সেই প্রথম সম্ভাষণই শেষ বিদায়-সম্ভাষণ – আমার সেই প্রথম চুম্বনই শেষ চুম্বন! কারণ, আর তাকে দেখতে পাইনি। আমি চলে আসবার মাস দুই পরেই পিত্রালয়ে সে আমায় চিরজনমের মতো কাঁদিয়ে চলে যায়। প্রথম যখন সংবাদটা পেলুম, তখন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হল না। এত বড়ো দুঃখ দিয়ে সে আমায় চলে যাবে? আমার এই আহত প্রাণ চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, ‘না গো না, সে মরতেই পারে না! স্বামীকে না জানিয়ে সে এমন করে চলে যেতেই পারে না। সব শত্রু হয়ে তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা জানিয়েছে’। আমি পাগলের মতো রাবেয়াদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলুম। আমায় দেখে তাদের পুরোনো শোক আবার নতুন করে জেগে উঠল। বাড়িময় এক উচ্চ ক্রন্দনের হাহাকার রোল আমার হৃদয়ে বজ্রের মতো এসে বাজল। আমি মূর্ছিত হয়ে পড়লুম। – ওগো, আর তার মৌন অশ্রুজল আমার পাষাণ বক্ষ সিক্ত করবে না? একটি কথাও যে বলতে পারেনি সে। সে যাবে না, কক্ষণো যাবে না। ‘হায় অভিমানিনী! ফিরে এসো! ফিরে এসো।’

সে এল না, যখন নিঝুম রাত্তির, কেউ জেগে নেই, কেবল একটা ‘ফেরু’ ফেউ ফেউ চিৎকার করে আমার বক্ষের স্পন্দন দ্রুততর করে তুলছিল, তখন একবার তার গোরের উপর গিয়ে উপুড় হয়ে পড়লুম – ‘রাবেয়া! প্রিয়তমে! একবার ওঠো, আমি এসেছি, সকল দুষ্টোমি ছেড়ে এসেছি। আমার সারা বক্ষ জুড়ে যে তোমারই আলেখ্য আঁকা, তাই দেখাতে এই নিভৃত গোরস্থানে নীরব যামিনীতে একা এসেছি। ওঠো, অভিমানিনী রাবেয়া আমার, কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না।’ কবর ধরে সমস্ত রাত্তির কাঁদলুম, রাবেয়া এল না। আমার চারিদিকে একটা ঘূর্ণিবায়ু হুহু করে কেঁদে ফিরতে লাগল, ছোট্ট শিউলি গাছ থেকে শিশিরসিক্ত ফুলগুলো আমার মাথার ঝরে পড়তে লাগল। ও আমার রাবেয়ার অশ্রুবিন্দু, না কারুর সান্ত্বনা? দু-একটা ধসে যাওয়া কবরে দপ দপ করে আলেয়ার আলো জ্বলে উঠতে লাগল। আমি শিউরে উঠলুম। তখন ভোর হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সর্বাঙ্গে তার কবরের মাটি মেখে আবার ছুটে এলুম বর্ধমানে। হায়, সে তো চলে গেল, কিন্তু আমার প্রাণে স্মৃতির যে আগুন জ্বেলে গেল সে তো আর নিবল না। সে আগুন যে ক্রমেই বেড়ে চলেছে, আমার বুক যে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। এই প্রাণ-পোড়ানো স্মৃতির আগুন ছাড়া একটা কোনো নিদর্শন যে সে রেখে যায়নি, যাতে করে আমার প্রাণে এতটুকু সান্ত্বনা পেতুম।

সেই যে আঘাত পেলুম, তাতেই আমার বুকের পাঁজর ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল। আমি আর উঠতে পারলুম না।

 

[ ঘ ]

‘দিন যায়, থাকে না। আমারও নীরস দিনগুলো কেটে যেতে লাগল কোনো রকমে। ক্রমে ফার্স্ট ক্লাসে উঠলুম। তখন অনেকটা শুধরেছি। ইতিমধ্যে বর্ধমান ‘নিউ স্কুল’ উঠে যাওয়ায়, তাছাড়া অন্য জায়গায় গেলে কতকটা প্রকৃতিস্থ হতে পারব আশায়, আমি রানিগঞ্জে এসে পড়তে লাগলুম। আমাদের ভূতপূর্ব হেডমাস্টার রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ-স্কুলের হেডমাস্টারি পদ পেয়েছিলেন। তাঁর পুরোনো ছাত্র বলে তিনি আমায় স্নেহের চক্ষে দেখতে লাগলেন, আমিও পড়া-লেখায় একটু মন দিলুম। কিন্তু ইতিমধ্যে আর একটা বিভ্রাট বেধে গেল, আমার আবার বিয়ে হয়ে গেল। তুমি শুনে আশ্চর্য হবে, আমি এ বিয়েতে কোনো ওজর আপত্তি করিনি। তখন আমার মধ্যে সে উৎসাহ সে একগুঁয়েমি আর ছিল না। রাবেয়ার মৃত্যুর সঙ্গে আমি যেন একেবারেই পরনির্ভরশীল বালকের মতো হয়ে পড়লুম। যে যা বলত তাতে উদাসীনের মতো ‘হ্যাঁ’ বলে দিতুম। কোনো জিনিস তলিয়ে বুঝবার বা নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করবার ক্ষমতা যেন তখন আমার আদৌ ছিল না। আমার পাগলামি, হাসি সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। এইসব দেখেই বোধ হয় মা আমার আবার বে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আমি আরও ভেবেছিলুম হয়তো এই নবোঢ়ার মধ্যেই আমার রাবেয়াকে ফিরে পাব, আর তার স্নেহকোমল স্পর্শ হয়তো আমার বুকের দারুণ শোক-যন্ত্রণার মধ্যে শান্তি আনতে পারবে। কিন্তু হায়! যার জীবন চিরকালই এই রকম বিষাদময় হবে বলে বিধাতার মন্তব্য-বহিতে লিখিত হয়ে গেছে, তার ‘সবর’ ও ‘শোকর’ ভিন্ন নান্যগতি। তার কপাল চিরদিনই পুড়বে। নববধূ সখিনা দেখতে শুনতে মন্দ নয়, তাই বলে ডানাকাটা পরিও নয়; আর আমার নিজের চেহারার গুণ বিচার না করে ওরকম একটি পরির কামনা করাও অন্যায় ও ধৃষ্টতা। গুণও আমার তুলনায় অনেক বেশি, সেসব বিষয়ে কোথাও খুঁত ছিল না। আজকালকার ছোকরারা নিতান্ত বেহায়ার মতো নিজে বউ পছন্দ করে আনে। নিজের শরীর যে আবলুস কাঠের চেয়েও কালো বা কেঁদ কাঠের চেয়েও এবড়োখেবড়ো সেদিকে দৃষ্টি নেই, কিন্তু বউটির হওয়া চাই দস্তুরমতো দুধে-আলতার রং, হরিণের মতো নয়ন, অন্তত পটলচেরা তো চাই-ই, সিংহের মতো কটিদেশ, চাঁদের মতো মুখ, কোকিলের মতো কণ্ঠস্বর, রাজহংসীর মতো গমন; রাতুল চরণকমল, কারণ মানভঞ্জনের সময় যদি ‘দেহি পদপল্লবম্ উদারম্’ বলে তাঁর চরণ ধরে ধন্না দিতে হয়, আর সেই যে চরণ যদি God forbid (খোদা বা করেন) গদাধরের পিসির ঠ্যাং-এর মতোই শক্ত কাঠপারা হয়, তাহলে বেচারা একটা আরাম পাওয়া হতে যে বঞ্চিত হয়, আর বেজায় রসভঙ্গও হয়। তৎসঙ্গে আরও কত কী কবিপ্রসিদ্ধির চিজবস্তু, সেসব আমার আর এখন ইয়াদ নেই। এইসব বোকারা ভুলেও ভাবে না যে, মেয়েগুলো নিতান্ত সতীলক্ষ্মী গোবেচারার জাত হলেও তাদেরও একটা পছন্দ আছে। তারাও ভালো বর পেতে চায়। আমরা যত সব পুরুষ মানুষ বেজায় স্বার্থপর বলে তাদের কোনো কষ্ট দেখেও দেখি নে। মেয়েদের ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ ভাব আমি বিলকুল না-পছন্দ করি। অন্তত যার সঙ্গে সারা জীবনটা কাটাতে হবে, পরোক্ষেও যদি তার সম্বন্ধে বেচারিরা কিছু বলতে কইতে না পায়, তবে তাদের পোড়াকপালি নাম সার্থক হয়েছে বলতে হবে। থাক, আমার মতো চুনোপুঁটির এ-সব ছেঁদো কথায় বিজ্ঞ সমাজ কেয়ার তো করবেনই না, অধিকন্তু হয়তো আমার মস্তক লোমশূন্য করে তাতে কোনো বিশেষ পদার্থ ঢেলে দিয়ে তাঁদের সীমানার বাইরে তাড়িয়ে দেবেন। অতএব আমি নিজের কথাই বলে যাই।

নব পরিণীতা সখিনার এসব গুণ থাকা সত্ত্বেও আমি তাকে ভালোবাসতে পারলুম না। অনেক ‘রিহার্স্যাল’ দিলুম, কিছুতেই কিছু হল না। হৃদয় নিয়ে এ ছিনিমিনি খেলার অভিনয় যেন আর ভালো লাগছিল না। তাছাড়া তুমি বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না, রাবেয়া যেন আমার হৃদয় জুড়ে রানির মতো সিংহাসন পেতে বসেছিল, সেখানে অন্য কারুর প্রবেশাধিকার ছিল না। একনিষ্ঠ প্রেমে মানুষকে এতটা আত্মহারা যদি না করে ফেলত তবে ‘কায়েস’ ‘মজনু’ হয়ে লায়লীর জন্য এমন করে বনে-পাহাড়ে ছুটে বেড়াত না, ফরহাদের ও-রকম পরিণাম হত না। সখিনা কত ব্যথা পাচ্ছে বুঝতে পারতুম, কিন্তু হায়, বুঝেও কিছু করতে পারতুম না। বিবাহিতা পত্নীর প্রতি কর্তব্যের অবহেলা আমার বুকে কাঁটার মতো বিঁধছিল। মা ক্ষুণ্ন হলেন, বোনেরা বউকেই দোষী সাব্যস্ত করে তালিম করতে লাগল। কিন্তু কোথায় কী ফাঁক রয়ে গেল জানি না, কিছুতেই তার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয়ের মিশ খেল না। সে কেঁদে মাটি ভিজিয়ে দিলে, তবু মন ভিজল না। অনুশোচনার ও বাক্যজ্বালার যন্ত্রণায় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলুম। রাবেয়া আমার বুকে যে আঘাত করে গিয়েছিল তাই সইতে পারছিলুম না, তার উপর – হা খোদা, এ কী করলুম নিতান্ত অর্বাচীনের মতো? এ হতভাগিনির জীবন কেন আমার সঙ্গে এমন করে জড়িয়ে ফেললুম? অসহ্য এই বৃশ্চিক যন্ত্রণা কাঁটার মতো আমার আগেকার আঘাতটায় খোঁচা মারতে লাগল। আমি পাগল হয়ে যাওয়ার মতো হলুম। এরই মধ্যে রানিগঞ্জে এসে ‘টেস্ট একজামিনেশন’ দিলুম। সমস্ত বছর হট্টগোলে কাটিয়েছি। পাশ করব কোত্থেকে? আগেকার সে চুরি বিদ্যায়ও প্রবৃত্তি ছিল না – অর্থাৎ এখন সাফ বুঝতে পাচ্ছ যে, টেস্টে এলাউ হইনি; সুতরাং ওটা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এই শুভ সংবাদ বাবার কর্ণগোচর হবা মাত্র তিনি কিঞ্চিদধিক এক দিস্তা কাগজ খরচ করে আমায় বিচিত্র সম্ভাষণের উপসংহারে জানিয়ে দিলেন যে, আমার মতো কুপুত্তুরের লেখাপড়া ওইখানেই খতম হবে তা তিনি বহু পূর্বেই আন্দাজ করে রেখেছিলেন, – অনর্থক এক রাশ টাকা জলে ফেলে দিলেন ইত্যাদি। আমার জানটা তেতবেরক্ত হয়ে উঠল। ‘দুত্তোর’ বলে দফতর গুটালুম। পরে, যা মনে আসতে লাগল তাই করতে লাগলুম। লোকে আমায় বহরমপুর যাওয়ার জন্য বিনা ফি-তে যেচে উপদেশ দিতে লাগল। আমি তাদের কথায় ‘ড্যামকেয়ার’ করে দিনরাত বোঁ হয়ে রইলুম। দু-চারদিন সইতে সইতে শেষে একদিন বোর্ডিং সুপারিনটেন্ডেন্ট মশাই শুভক্ষণে আমায় অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় দিলেন। আমি ফের বর্ধমানে চলে এলুম। আমাদের ছত্রভঙ্গদলের ভূতপূর্ব গুণ্ডাগণ আমায় সাদরে বরণ করে নিল। পিতা সব শুনে আমায় ত্যাজ্যপুত্র করলেন। এক বৎসর পরে খবর এল সখিনা আমায় নিষ্ঠুর উপহাস করে অজানার রাজ্যে চলে গেছে। মরবার সময়ও নাকি হতভাগিনি আমার মতো পাপিষ্ঠের চরণ-ধুলোর জন্য কেঁদেছে, আমার ছেঁড়া পুরোনো একটা ফটো বুকে ধরে মরেছে। ক্রমেই আমার রাস্তা ফরসা হতে লাগল। আরও ছয় মাস পর মা-ও চলে গেলেন। আমি তখন অট্টহাসি হেসে বোতলের পর বোতল উড়াতে লাগলুম। তারপর শুভক্ষণে পলটনে এসে সেঁদিয়ে পড়লুম বোম কেদারনাথ বলে। আর এক গ্লাস জল দিতে পারো ভাই?

Deja un comentario

Nombre *
Añadir un nombre para mostrar
Correo electrónico *
Tu correo electrónico no será publicado

Este sitio usa Akismet para reducir el spam. Aprende cómo se procesan los datos de tus comentarios.

es_ESEspañol