মৃত্যুক্ষুধা – ২৫

Any Subtitlejunio 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ২৫

মেজোবউ ঝড়ের মতো প্যাঁকালের ঘরে এসে ডেকে উঠল, ‘কুর্শি’!

মেজোবউয়ের এমনতর স্বর কুর্শি কখনও শুনে নাই। সে ভয় পেয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াতেই মেজেবিউ বললে, “কী চিঠি এসেছে দেখি!”

কুর্শি নিঃশব্দে চিঠি এনে দিল। তারও তখন পা কাঁপছে! তারা আসা অবধি এই এক বছরের মধ্যে কারুর কোনো চিঠি পায়নি। হঠাৎ আজ বিয়ারিং চিঠি দেখে সকলেই মনে করছিল, না জানি কার কোনো দুঃসংবাদ আছে এতে!

মেজেবিউ হেরিকেনের কাছে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চিঠি খুলে খানিকটা পড়েই একেবারে মাটিতে পড়ে চিৎকার করে উঠল, “খোকা! খোকা! বাপ আমার!”

ততক্ষণ প্যাঁকালে এসে পড়েছিল। সে আসতেই মেজোবউ একেবারে তার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে বলে উঠল, “আমার খোকা বুঝি আর বাঁচে না ভাই! সে তার এই পোড়াকপালি মাকে দেখতে চায়। আমায় নিয়ে চলো, তোমার পায়ে পড়ি ভাই, আমায় নিয়ে চলো!” বলেই সে মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ল।

প্যাঁকালে, কুর্শি বহু কষ্টে মূৰ্ছা ভাঙালে।

আজ এক বৎসর ধরে বরিশাল এসেছে ওরা। এর মধ্যে কেউ কোনো চিঠি দেয়নি। মেজোবউ কীসের যেন আতঙ্কে কৃষ্ণনগরের নাম পর্যন্ত শুনলে পালিয়ে যেত। তার কেবলই মনে হত, এই বুঝি তার খোকা-খুকির অসুখের খবর এসে পড়ল। সে দিনরাত প্রার্থনা করত, ওরা ভালো থাক, বেঁচে থাক, কিন্তু কোনো চিঠি যেন কোনো দিন না আসে। কিন্তু সোয়াস্তিও ছিল না তার, সে ঘুমে-জাগরণে – সব সময় যেন তার ক্ষুধাতুর শিশুদের কান্না শুনতে পেত। সে রাক্ষুসী! ইচ্ছা করেই ছেলেমেয়েদের ফেলে এসেছিল। চলে আসার দিন তাকে যেন ভূতে পেয়েছিল! তাকে এদেশ ছেড়ে যেতে হবে, শুধু এই কথাই তার মনে হচ্ছিল। সে যে মা, সে-কথা সেদিন সে ভুলে গিয়েছিল।

একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে মেজেবউ আবার সমস্ত চিঠিটা পড়ল। প্যাঁকালের মা চিঠি লিখছে – লিখছে মানে কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে। খোকার অর্থাৎ মেজোবউয়ের ছেলের ভয়ানক অসুখ, টাইফয়েড। বোধ হয় বাঁচবে না। যে ছেলে এক বছর ধরে ভুলেও তার মায়ের নাম মুখে আনেনি, সে আজ বিকারের ঘোরে কেবলই বলছে, “আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চল!” প্যাঁকালের মাও মৃত্যুশয্যায়। কিন্তু মরবার আগে সে যেন যার ছেলে তার হাতেই দিয়ে যেতে পারে। ছেলের কান্না শুনে গাছের পাতা ঝরে পড়ে, আর ওর রাক্ষুসী মা-র মন গলবে না!

সেইদিন রাত্রেই মেজোবউ, প্যাঁকালে, কুর্শি কৃষ্ণনগর যাত্রা করল। যাওয়ার আদেশ পেতে তাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় মিশনারি কর্তারা মেজোবউকে ভালো করেই চিনতেন! কাজেই তারা আপত্তি করলেও যাওয়া বন্ধ করতে সাহস করলেন না।

পরদিন সন্ধ্যায় অন্ধকার যখন গাঢ়তর হয়ে আসছে, সেই সময় তারা কৃষ্ণনগর স্টেশন এসে পৌঁছল। এই একটা বছরের মধ্যে কত পরিবর্তনেই না হয়ে গেছে এর! মেজোবউয়ের শোকাচ্ছন্ন চোখের মলিন দৃষ্টির ম্লানিমা লেগে স্টেশনের কয়লা-রঞ্জিত পথ যেন আরও কালো হয়ে উঠল। তার মনে হল, কে যেন তার স্থূল হাতের কর্কশ পরশ বুলিয়ে সেই পূর্বের কৃষ্ণনগরের সব সৌন্দর্য মুছে নিয়ে গেছে।

একটা ছ্যাকড়া গাড়িতে উঠেই মেজোবউ বললে, “খুব জোরে হাঁকাও।” এতক্ষণ এত দুর পথে আসতে যে হৃৎস্পন্দনের চঞ্চলতা তাকে অধীর করে তোলেনি, স্টেশনে নেমেই তার চঞ্চলতা যেন শতগুণে বেড়ে উঠল। একবার মনে হল, এ রাস্তায় যেন শেষ না হয়। এই গাড়ি যেন এই রকম করে অনন্তকাল ধরে ছুটতে থাকে।…হয়তো এতক্ষণে তার খোকার মুখে ‘মা’ডাক নিঃশেষিত হয়ে গেছে!

কোচোয়ানের চাবুক খেয়ে ঘৃত-পক্ক অশ্বিনীকুমারদ্বয় যেটুকু স্পিড বাড়ালে, তাকে ঘোড়া-দৌড় ঠিক বলা চলে না, সে কতকটা খোঁড়া-দৌড়! তাতে যেমনই হাসি পায়, তেমনই অসহায় জীব গুলির প্রতি করুণায় মন ভরে ওঠে। কিন্তু ঘোড়ার চেয়েও আর্তনাদ করতে লাগল গাড়ির চাকাগুলো। তারা যেন আর গড়াতে পারে না। পথের বুকে মুখ ঘষে ঘষে যেন তাদের প্রতিবাদ-ক্রন্দন জানাতে থাকে। রাস্তাও তেমনই। যেন দাঁত বের করে মিউনিসিপ্যালিটিকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে!

ঢিকুতে ঢিকুতে গাড়ি এসে প্যাঁকালেদের বাড়ির দোরে লাগল। ভিতর থেকে কোনো শব্দ শোনা গেল না। ভিতরে কেউ আছে বলেও মনে হল না। একটা মৃৎ-প্রদিপের ক্ষীণ-শিখার আশ্বাসও নেই সেখানে।

মেজোবউয়ের বুক অজানা আশঙ্কায় হা হা করে উঠল! তার অন্তরে যেন অনন্ত আকাশের শূন্যতায় রিক্ত আর্তনাদ ধ্বনিত হয়ে উঠল। সে টলতে টলতে গাড়ি থেকে নেমে দোরের গোড়ায় আছড়ে পড়ে আর্তনাদ করে উঠল, ‘খোকা!’

কে যেন তার টুঁটি চেপে ধরেছে।

শূন্য ঘরের বুক থেকে কার যেন ক্ষীণ আর্তনাদ শোনা গেল! ও আর্তনাদ যেন এপারের নয়, সাঁতরে পার-হওয়া নদীপারের শ্রান্ত যাত্রীর।

প্যাঁকালে ততক্ষণে বন্ধ ঘরের আগড় খুলে ঢুকে পড়েছে। তার পায়ে কঙ্কালের মতো কী একটা ঠেকতেই সে চিৎকার করে উঠল, ‘মা! মা!’

হঠাৎ রান্নাঘরের দোর খুলে গেল; এবং তার ভিতর থেকে বড়োবউ বেরিয়ে এসে ভয়াতুর শীর্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে?’

মেজোবউয়ের মূর্ছাতুর কণ্ঠে আর একবার শুধু একটু অস্পষ্ট অনুনয় ধ্বনিত হল, “খোকা, আমার খোকা কই?”

বড়োবউ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, “রাক্ষুসি, এতদিনে এলি! খোকা নেই! কাল সকালে সে চলে গেছে!”

মেজোবউ ‘খোকা’বলে আহত বিহগীর মতো সেইখানেই লুটিয়ে পড়ল!… প্যাঁকালে আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, “বড়োবউ, কী ভীষণ অন্ধকার! আর সহ্য করতে পারছিনে, বাতি, বাতি কই?”

বড়োবউ তেমনই কান্না-দীর্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, “বাতি নেই! সব বাতি নিবে গেছে! ঘরে এক ফোঁটা তেল নেই।”

প্যাঁকালে উন্মাদের মতো ভাঙা ঘরের চালা থেকে একরাশ পচা খড় টেনে জ্বালিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “তা হলে ঘরই পুড়ুক!”

সেই রক্ত-আলোকে দেখা গেল, প্যাঁকালের মা তার কঙ্কাল আর আবরণ চামড়াটুকু নিয়ে তখনও ধুঁকছে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়!

প্যাঁকালে ‘মা’বলে তার মায়ের বুকে পড়তেই বৃদ্ধার চক্ষু একটু জ্বলে উঠেই পেক্ষণে নিবে গেল চিরকালের জন্য!

চালের খড় তখনও ধুধু করে জ্বলছে, ওদেরই বুকের আগুনের মতো। একটু পরে সে অগ্নিশিখাও যেন অতি শোকে মূর্ছিত হয়ে পড়ল।

Deja un comentario

Nombre *
Añadir un nombre para mostrar
Correo electrónico *
Tu correo electrónico no será publicado

Este sitio usa Akismet para reducir el spam. Aprende cómo se procesan los datos de tus comentarios.

es_ESEspañol