মৃত্যুক্ষুধা – ২৬

Any Subtitlejunio 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ২৬

পাড়ার লোকে মেজোবউকে দেখলেই বলে, “ও রাক্ষুসি! ওর বুকে শুধু লোহা আর পাথর!”

খোকা চলে গেছে। মেয়ে পটলিকে নিয়ে মেজোবউ আবার আগের মতো পান খেয়ে রেশমি চুড়ি পরে, বাঁকা সিঁথি কেটে, চওড়া কালো-পেড়ে শাড়ি পড়ে কস্তা-পেড়ে হাসি হেসে পাড়া বেড়ায়।

মাত্র মাস খানেক হল ছেলে মরেছে।

মূর্ছাভঙ্গের পরই মেজোবউ উন্মাদিনীর মতো তার ছেলের যা কিছু স্মৃতি-চিহ্ন যেখানে ছিল, মায় শতছিন্ন কাঁথাটি পর্যন্ত, – সব পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে! তাও ওই সঙ্গে পুড়িয়েছে।

তার হৃদয়ের সমস্ত শোক-জ্বালাকেও যেন ওইদিনই চিরদিনের মতো ভস্মীভূত করে দিয়েছে। তারপরে নিজেই সে আগুন নিবিয়েছে কলসি কলসি চোখের জল ঢেলে! আজ যেন তার আর কোনো শোক নেই, কোন দুঃখ-গ্লানি নেই! চোখের জলও যেন ওই সঙ্গেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে!

এ যেন তার আর এক জন্ম! সে যেন নবজন্মের নতুন লোকের নতুন মানুষ।

মেয়ে পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায়, তার যত্ন নেয় না। ও যেন ওর মেয়েই নয়। কেউ বলে, শোকে পাগল হয়েছে, কেউ বলে রসের পাগল!

ওই ঘরেই সে থাকে, মিশনারি সাহেব-মেমদের বহু অনুরোধ সত্ত্বেও সে সেখানে যায়নি, কিন্তু আবার তৌবা করে মুসলমানও হয়নি।

প্যাঁকালেকে স্থানীয় খান বাহাদুর সাহেব একটি কুড়ি টাকার চাকুরি জুটিয়ে দেওয়াতে সে আবার কল‍্‍মা পড়ে মুসলমান হয়ে গেছে। কুর্শির বাবা মধু ঘরামি অনেকদিন আগেই মারা গেছে। কাজেই কুর্শিও খানিক কেঁদে-কেটে শেষে প্যাঁকালের ধর্মকে গ্রহণ করেছে। সুতরাং ওদের দিন বেশ একরকম চলে যাচ্ছে।

শুধু মেজোবউ যেন ঘরে থেকেও ঘরের কেউ নয়! এর-ওর বাড়ি যায় এবং যায় একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই ধোপা-দোরস্ত হয়ে! কাজেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকে তাকে একখানা চৌকি এগিয়ে দেয়। তাদের ধারণা, মেজোবউ এই এক বছরে না জানি বহু সাহেব-কাপ্তেন পাকড়ে টাকার কুমির হয়ে এসেছে! দুঃখ-ধান্ধা করে খায়, কাজেই আগের থেকে একটু মুখের ভাবটা থাকলেও হয়তো বা কালে-কবুসে হাত পাতলে কোনো না দুটো টাকা পাওয়া যাবে!

সত্যি-সত্যিই মেজোবউ কিছু টাকা জমিয়েছিল, কিন্তু সে দু একশো মাত্র, ওর বেশি নয়। তাই সে বিবিয়ানি করে উড়াচ্ছে, এরপর কী হবে, বা কী করে চলবে, সে চিন্তাও যেন সে করে না।

তার টাকার লোভে বাড়ির লোকেও কেউ কিছু বলতে সাহস করে না।

পাড়ার মোড়ল হিসিবি লোক, অনেক চিন্তার পর সে স্থির করলে যে, পাড়ার কোনো মুসলমান ছোকরাকে দিয়ে ওর রসস্থ মন ভুলাতে পারলে ওকে অনায়াসেই স্বধর্মে ফিরিয়ে এনে একজন নাসারকে মুসলিম করার গৌরব ও পুণ্যের অধিকারী হতে পারবে। কাজেই সে মউলবি সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে আর বেশি পীড়াপীড়ি করলে না এ নিয়ে। কী জানি, যদিই বেশি টানে দড়ি ছিঁড়ে যায়!

কেউ কিছু বললে মোড়ল হেসে বলে, “বাবা, এখন দিগদড়ি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। যাবে কোথা? একটু চরে খাক, তারপর ঘরের গাই ঘরে ফিরে আসবে!”

মোড়লের বুদ্ধির তারিফ করতে করতে তারা ফিরে যায়।

মেজোবউ লতিফার কাছেই যায় সব চেয়ে বেশি করে। লতিফা যে আবহাওয়ার মধ্যে ছেলেবেলা থেকে মানুষ, তাতে করে সে চিরকাল হৃদয়টাকেই বড়ো করে দেখতে শিখেছে। মেজোবউয়ের ভিতরে যে আগুন সে দেখেছিল, তাকেই সে শ্রদ্ধা করে। কাজেই তাকে স্বধর্মে ফেরানো নিয়ে কোনোদিনই পীড়াপীড়ি করেনি! নাজির সাহেব বেচারা একেবারে যাকে বলে মাটির মানুষ। এ নিয়ে ওঁর কোনো মাথা-ব্যথাই নেই। শুধু লতিফাকে রহস্যের ছলে এ নিয়ে একটু চিমটি কাটেন মাত্র। বলেন, “দেখো গো, শেষে তুমিও যেন আড়কাঠির পাল্লায় পড়ে আমায় অকূলে না ভাসাও!”

লতিফা হেসে বলে, “তুমি তো ভাসবার মতো হালকা নও, তোমার বরং ডুববারই বেশি ভয়। তা সে দিক ভয় আমারই বেশি! আমিই তো খাল কেটে বেনোজল আর কুমির দুই-ই ঘরে আনছি!”

নাজির সাহেব নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “নাঃ! ডুববার মতোই বপুটা ক্রমেই স্থূল হচ্ছে বটে! এইবার থেকেই রাত্তিরে উপোস দিয়ে এ বরবপু একটু হালকা করতে হবে – অন্তত ভেসে যাবার মতো!”

লতিফা নাজির সাহেবের গায়ে থুতকুড়ি দিয়ে কটাস করে রাম-চিমটি কেটে বলে, “ষাট! বালাই! তোমায় কে মোটা বলে! তার চোখে ভ্যালার আঠা দিয়ে দেব!”

নাজির সাহেব ‘উহু উহু’করে ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে বলেন, “বাপ রে বাপ! আগে জানলে কে এ সূর্পনখাকে বিয়ে করত…”

সেদিন সকালে উঠেই মেজোবউ হঠাৎ বলে উঠল, “বড়ো-বু! আমি আজ পাড়ার সমস্ত ছেলেদের খাওয়াব!”

বড়োবউ বুঝতে না পেরে বললে, ‘কেন?’

মেজোবউ সহজ কণ্ঠে বললে, “আজ খোকার চালশে।”

বড়োবউয়ের দুই চোখ জলে ভরে উঠল। সত্যিই তো আজ চল্লিশ দিন হল খোকা চলে গেছে! মেজোবউ তাহলে ভোলেনি। ভুলবার ভান করে মাত্র। বড়োবউ চোখের জল মুছে বলে উঠল, “তা তোর ছেলের নামে খাওয়াবি, ওতে আমাদের কী বলবার আছে ভাই! কিন্তু একবার পাড়ার মোড়ল আর মউলবি সাহেবকে তো বলতে হয়।”

মেজোবউ তেমনই শান্তকন্ঠে বললে, “না ওদের কাউকে বলব না। শুধু ছোটো ছোটো খোকাদের ডেকে নিজে রেঁধে খাওয়াব।”

বড়োবউ কেঁদে ফেলে বললে, “ওরে পাগলি! মোড়ল না বললে, কেউ যে তার ছেলেকে তোর হাতের রান্না খেতে দেবে না!”

মেজোবউ একটু থেমে বলে উঠল, “ওঃ আমি যে খ্রিস্টাননি। তা যে করেই হোক, আমি খাওয়াবই!” বলেই সে কিছু না বলে মোড়লের বাড়ি হাজির হল।

মোড়ল দেখলে, এই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সুযোগ। এই সুযোগ ছাড়লে তবে আর ঘরে ফেরানো যাবে না। সে খুব ভালোমানুষ সেজে বললে, “তা কী করব বল মা, তুই তো আমার মেয়ের মতোই। খ্রিস্টানের হাতে আমি বললেও কেউ খাবে না! মরে গেলেও না।”

মেজোবউয়ের দগ্ধ-চোখে সহসা যেন অশ্রুর পুঞ্জীভূত মেঘ ঘনিয়ে এল। তার মনে পড়ল কতদিন নিরাহারে কাটিয়ে তার খোকা চলে গেছে! তার সমস্ত মন যেন হাহাকার করে আর্তনাদ করে উঠল। সে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। ডুকরে কেঁদে উঠে সামনের উঠানে লুটিয়ে পড়ে বলতে লাগল, “আমি আজই মুসলমান হব! আমার খোকার আত্মা যেন চিরকালের ক্ষুধা নিয়ে না ফিরে যায়!

মোড়ল যেন হাতে চাঁদ পেল। সে তখনই উঠে মেজোবউকে তুলে বলল, “এই তো মা, এতদিনের মানুষের মতো, মায়ের মতো কথা বললি। তোর খোকা মরবার সময় পর্যন্ত বিকারের ঘোরে বলেছে, ‘মা, তুই খেরেস্তান, তোর হাতের পানি খাব না।’তুই মুসলমান না হয়ে ওর ফাতেহা না দিলে ওর শাস্তি হবে।”

মেজোবউ দুই কানে আঙুল দিয়ে বলে উঠল, “আর ওর নাম কোরো না আমার কাছে। ওর কোনো কথা বোলো না। আজ পাড়ার সব ছেলেই আমার খোকা।”

মোড়ল মাথায় হাত দিয়ে বললে, “তাই হোক! ওরাই তোর খোকা হোক। ওদেরে খাইয়ে, কোলে করে তুই তোর খোকার শোক ভোল।”

মেজোবউ চলে গেলে মোড়ল আপন মনেই বলে উঠল, “রাক্ষুসি হলেও মা তো। নাড়ির টান যাবে কোথায়?”

Deja un comentario

Nombre *
Añadir un nombre para mostrar
Correo electrónico *
Tu correo electrónico no será publicado

Este sitio usa Akismet para reducir el spam. Aprende cómo se procesan los datos de tus comentarios.

es_ESEspañol