০৯. পরির কথা

Any Subtitlejunio 28, 2023

[ad_1]

ময়ূরেশ্বর – বীরভূম
সব ছাপিয়ে আমার মনে পড়ছে তাঁরই গাওয়া অনেক আগের একটা গানের সান্ত্বনা, –

অনেক পাওয়ার মাঝে মাঝে কবে কখন একটুখানি পাওয়া
সেইটুকুতেই জাগায় দখিন হাওয়া,
দিনের পরে দিন চলে যায় যেন তারা পথের স্রোতেই ভাসা,
বাহির হতেই তাদের যাওয়া আসা;
কখন আসে একটি সকাল সে যেন মোর ঘরেই বাঁধে বাসা,
সে যেন মোর চিরদিনের চাওয়া।
হারিয়ে যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা কুড়িয়ে পেলেম যারে,
রইল গাঁথা মোর জীবনের হারে;

সেই যে আমার জোড়া-দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা,
সেই নিয়ে আজ সাজাই আমার থালা।
এক পলকের পুলক যত, এক নিমেষের প্রদীপখানি জ্বালা,
একতারাতে আধখানা গান গাওয়া!’

আমার আজ সেই কথাটাই বারে বারে মনে হচ্ছে যে, যাকে হারিয়ে-যাওয়া আলোর মাঝে কণা কণা করে কুড়িয়ে পেলুম, সেই আমার জীবনের হারে গাঁথা রইল! আর সেই আমার জোড়া দেওয়া ছিন্ন দিনের খণ্ড আলোর মালা নিয়ে আজ আমার দুখের থালা সাজিয়ে বসে আছি, – ওঃ সে বড়ো আশায়! – এ কোন্-সেদিনের আশায় আর কার প্রতীক্ষায়?

* * *
তিনি যখন আমায় আশীর্বাদ করতে এলেন, তখন একবার মনে হল বুঝি এইবার আমার সকল বাঁধন টুটল! ওঃ খোদা! আমাদের বুকে তুমি রাশি রাশি ব্যথা আর দুঃখ বোঝাই করে রেখেছ, তা সহ্য করতে তেমনই ধৈর্য-শক্তি যদি আমাদের না দিতে তাহলে আমাদের লজ্জা রাখবার আর জায়গা থাকত না, – অপমানের চূড়ান্ত হত! সেদিন আমি নিজেকে সংযত করতে না পারলে আমার নারীত্বের মাথায় যে পদাঘাত পড়ত, তাতে আমি হয়তো আর এই আজকের মতো মাথা তুলেই দাঁড়াতে পারতাম না! তুমি হৃদয়ে বল দিয়েছ প্রভু, তাই অসংকোচে এমন একটা গৌরব অনুভব করতে পারছি আজ, হোক না কেন সে গৌরব বড়ো কষ্টের!

আমার ভালোবাসাই হয়তো তাঁর কর্তব্যের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর সুখের জন্যে, তাঁর তৃপ্তির জন্যে আমি কেন তবে সে-পথ হতে সরে দাঁড়াব না? আমার সর্বস্বের বিনিময়েও যে তাঁকে সুখী করতে পেরেছি, এই তো আমার শ্রেষ্ঠ সান্ত্বনা।

এই তাঁর চিন্তাটা যে আজ হতে জোর করে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, সেইটাই আমায় সবচেয়ে কষ্ট দিচ্ছে। বাইরের শাসন আর ভিতরের শাসন এই দুটোয় মস্ত টানাটানি পড়ে গিয়েছে এখন। – সমাজ, ধর্ম আমার মনকে মুখ ভেঙিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলছে, – ‘সে চিন্তাটা তোমার ভয়ানক অন্যায়, অমার্জনীয় পাপ।’

মনও বেশ প্রশান্ত হাসি হেসে বলছে, – আমি মিথ্যাকে মানব কেন? যা অন্তরের সত্য, সেইটাই আসল, সেইটাকে এড়িয়ে চললেই পাপ। গভীর সমাজ-তত্ত্বের সাথে গভীর সত্যের কথাটাও একবার ভেবে দেখো।

বাস্তবিক, অন্তরের গভীর সত্যকে বরণ করে নিতে গিয়ে সমাজ আর ধর্মকে আঘাত করা হয় বলে যদি মনে করি, তাহলে সেটা আমাদেরই ভুল; কারণ আমরা সমাজ আর ধর্মের অন্তর্নিহিত আদত সত্যকে উপেক্ষা করে তাদের বাইরের খোলসটাকে আঁকড়ে ধরে মনে করি, আমাদের মতো সত্যবিশ্বাসী আর নেই। আমাদের এ অন্ধবিশ্বাস যে মিথ্যা, তা সব চেয়ে বেশি করে জানি আমরা নিজেরাই। তবু সেটা আমরা কিছুতেই স্বীকার করব না, উলটে হাজার ‘ফ্যাচাং’-এর দলিল নজির পেশ করব! কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে অন্তরের সত্যকে উপেক্ষা করে এই যে আর একজনকে আমার স্বামী বলে নিজ মুখে মেনে নিলুম, তার কী হবে?

মনও যেন তখন বিরক্তি-বিতৃষ্ণায় জ্বলে উঠে বলে, – ‘হাঁ, একটা বড়ো কাজ করছ বলে এই যে এত বড়ো সত্যের অবমাননা করলে, তার শাস্তি খুব কঠোর নির্দয়ভাবেই পেতে হবে। এখন যে তাকে আর চিন্তা করতেও পাবে না, এইটাই তোমার উপযুক্ত শাস্তি!’

মনের এই অভিমান-ভরা উক্তিতে আমি না কেঁদে থাকতে পারি নে। আমারও কেন মনে হয় যে, আমি ইচ্ছে করেই তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছি, কিন্তু বুক-ভরা অভিমান আমার তাঁর বিরুদ্ধে এখনও জমে রয়েছে। প্রিয়ের বিরুদ্ধে এ অভিমান আমার জন্মে জন্মে সঞ্চিত রইল।

* * *
কাল ছিল আমার ফুলশয্যা। এই বাসর রাত্রিটি অনেক নারীর জীবনে মাত্র একটি নিশির জন্যেই সুখদ হয়ে আসে। এর বিনোদ স্মৃতিটা প্রভাতের শুকতারার চেয়েও স্নিগ্ধ উজ্জ্বল হয়ে দুঃখ-বেদনা-ক্লিষ্ট নারীর জীবনে অনেকখানি আনন্দের আলো বিকীর্ণ করে!

কিন্তু এমন সুখ-নিশিতেও কী জানি কেন কিছুতেই আমার উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন রোধ করতে পারছিলুম না। আমার স্বামী আমায় হাত ধরে তুলে আর্দ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, – ‘কেন কাঁদছ পরি?’ – ব্যথায় তাঁর স্বর আহত হয়ে উঠল!

আমি বড়ো কষ্টে উপাধানে তেমনি করে নিজের এই নির্লজ্জ চোখ দুটোকে লুকিয়ে মনে মনে বললুম, – ‘বুকে বড়ো বেদনা!’ আমার হাতে তাঁর তপ্ত অশ্রু টস্‌টস্ করে ঝরে পড়তে লাগল। পুরুষ মানুষ যে কত কষ্টে এমন করে কাঁদতে পারে, তা বুঝে আমার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া যেন বন্ধ হবার উপক্রম হল। একটু পরেই তিনি বেশ স্নিগ্ধ সহানুভূতির স্বরে যেন আমার মনের কথাটি টেনে নিয়ে বললেন, ‘তোমার বেদনা তো আমি জানি পরি, তোমার এ বুকজোড়া বেদনা কী দিয়ে আরাম করতে পারব বল?’

এক নিমেষে আমার লুপ্ত জ্ঞান যেন ফিরে এল। আমি সোজা হয়ে বসে বসলুম, – ‘আপনি সব জানেন?’

তিনি করুণ হাসি হেসে বললেন, – ‘তুমি বোধ হয় জান না, যে, আজহার আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমরা বরাবর দুজনে এক সঙ্গেই পড়েছি। সে যাবার আগে আমায় সব বলেছে! তাকে আমি বরাবরই চিনি, – সে মিথ্যা বলে না, সে শিশুর মতোই সরল। তবু সকল কথা জেনেও মনে হচ্ছে, আমি তাকে সুখী করতে গিয়েও কী যেন মস্ত অন্যায় করেছি। এখন ভাবছি যে, তাকে সুখী তো করতেই পারিনি, উল্‌টে তার দুঃখ-কষ্টকে হয়তো আরও বাড়িয়ে দিয়েছি। সে হতভাগা বোধ হয় শান্তিতে মরতেও পারবে না! এই আমার জীবনে প্রথম আর শেষ অন্যায়। – সে আমার পা ধরে মুক্তি চেয়েছিল। তখন কিন্তু বুঝিনি, সে কোন্ মুক্তি! – আমার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছি পরি, কিন্তু এতে আত্মতৃপ্তির চেয়ে আত্মগ্লানিই বেশি করে পেলুম; কেননা আমার অবস্থাটা এখন সেই রকমের হয়ে দাঁড়িয়েছে, যারা সবাইকে সন্তুষ্ট করতে চায়, অথচ কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না! … আজহার প্রতিজ্ঞা করেছে যে, এই কথাটা তার জীবনে আর দ্বিতীয়বার মুখ দিয়ে বেরুবে না, আর তার সত্যে আমার বিশ্বাস আছে। সে তোমাকে সুখী করবার জন্যে আমায় অনুরোধ করেছে। – বলো পরি, তুমি কিসে সুখী হবে?’

আমি তাঁর পায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললুম, – ‘তুমি আমায় এক বিন্দু ছেড়ে থেকো না, তোমার এই পায়ে এমনই করে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দিয়ো। আমার বড়ো কষ্ট!’…

অনেকক্ষণ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে থেকে তিনি আমায় বুকে তুলে নিয়ে বললেন, – ‘না পরি, পায়ে কেন, এই বুকে করে রাখব! এমন রত্ন সে হতভাগা কী করে জান ধরে আমায় বিলিয়ে দিতে পারল, তাই ভাবছি!’ – বলেই হেসে উঠলেন।

এক মুহূর্তে এই সোজা লোকটির সরলতায় আমার বুক বেদনায় আর শ্রদ্ধায় আলোড়িত হয়ে উঠল। তবু মনে মনে না বলে পারলুম না যে, এমন করে বিলিয়ে দিতে গেলে যে বড্ড বেশি ভালোবাসতে হয় আগে, এ ক্ষমতা কি যার তার থাকে? আবার কী মনে করে তিনি আমায় বলে উঠলেন, – ‘যা হয়ে গেছে, তার জন্যে খামোখা লজ্জিত হয়ো না পরি। – বীর সে, দেশের কাজে গিয়েছে, তাকে আর ডেকো না। মনে করো, যা হয়ে গেছে, তা শুধু ঘুমের ঘোরে!’ বলেই তিনি আবার মাথাটা জোর করে তুলে সুর করে গাইতে লাগলেন, –

‘সধবা অথবা বিধবা তোমার রহিবে উচ্চ শির,
উঠো বীর জায়া, বাঁধো কুন্তল, মুছো এ অশ্রু-নীর!’

এ কী রহস্য খোদা! … এ দেবতাকে যেন কোনোদিন প্রতারণা করি না, এই শক্তি দাও, হৃদয়ে এমনই বল দাও! – এখন শুধু শিশুর মতো ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। শান্তি দাও খোদা, শান্তি দাও এঁকে – তাঁকে, আর এমনই ব্যথিত বিশ্ববাসীকে!

আহা! ভালোবাসা দিয়ে যারা ভালোবাসা পায় না, তাদের জীবন বড়ো দুঃখের, বড়ো যাতনার! আবার এই জন্যে সেটা এত যাতনার যে, ওই না-ভালোবাসার দরুণ কাউকে অভিযোগ করবারও নেই। জোর করে তো আর কাউকে ভালোবাসানো যায় না।

আমি কি আবার ভালোবাসতে পারব গো! কী করে ভুলব? যে বিদায় নিয়ে এমন করে জয়ী হয়ে চলে গেল, তাকে যে সারা জীবনেও কিছুতেই ভোলা যায় না! তিনি যদি আমার সামনে থেকে অন্য কোনো দিকে জীবনটা সার্থক করে তুলতেন, তা হলে হয়তো তাঁকে ভুলতেও পারতাম। সব হারিয়ে যে এমন জীবনটা ব্যর্থ করে দিলে এই হতভাগিনির জন্যে, হায়! তাকে কি ভোলা যায়? নারীর ভালোবাসা কি এত ছোটো?

ওই যে এখনও আমার স্বামী তেমনই হাসিমুখে গাচ্ছেন, –

‘ওগো দেখি আঁখি তুলে চাও,
তোমার চোখে কেন ঘুম-ঘোর!’

Deja un comentario

Nombre *
Añadir un nombre para mostrar
Correo electrónico *
Tu correo electrónico no será publicado

Este sitio usa Akismet para reducir el spam. Aprende cómo se procesan los datos de tus comentarios.

es_ESEspañol