মৃত্যুক্ষুধা – ০৩

Any Subtitlejuin 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ০৩

এই সব ব্যাপারে কাজে যেতে সেদিন প্যাঁকালের বেশ একটু দেরি হয়ে গেল। তারই জুড়িদার আরও জন তিন-চার রাজমিস্তিরি এসে তাকে ডাকাডাকি আরম্ভ করে দিলে।

প্যাঁকালে না খেয়েই তার যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে এল। সে জানত কাল থেকে চালের হাঁড়িতে ইঁদুরদের দুর্ভিক্ষনিবারণী সভা বসেচে। তাদের কিচিরমিচির বক্তৃতায় আর নেংটে ভলান্টিয়ারদের হুটোপুটির চোটে সারারাত তার ঘুম হয়নি।

কিন্তু চাল যদিবা চারটে জোগাড় করা যেত ধারধুর করে, আজ আবার চুলোও নেই। উনুন-শালেই পাঁচির ছেলে হয়েছে। ও-ঘর নিকুতে সন্ধে হয়ে যাবে।

ঘরে তাদের চালের হাঁড়িগুলো যেমন ফুটো, চালও তেমনই সমান ফুটো। সেখানেই বাসা বাঁধবার খড় না পেয়ে চড়াই পাখিগুলো অনেকদিন হল উড়ে চলে গেছে। কিন্তু অর্থের চেয়েও বেশি টানাটানি ছিল তাদের জায়গার।

যেটা উনুন-শাল, সেইটেই ঢেঁকিশাল, সেইটেই রান্নাঘর এবং সেইটেই রাত্রে জনসাতেকের শোবার ঘর। তারই একপাশে দরমা বেঁধে গোটা বিশেক মুরগি এবং ছাগলের ডাক-বাংলো তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

প্যাঁকালে না খেয়েই কাজে গেল, তার মা-ও তা দেখলে। কিন্তু ওই শুধু দেখলে মাত্র, মনের কথা অন্তর্যামীই জানেন, চোখে কিন্তু তার জল দেখা গেল না। বরং দেখা গেল সে তার মায়ের আঁতুড়-ঘরে ঢুকে খোকাকে কোলে নিয়ে দোলা দিতে দিতে কী সব ছড়া-গান গাচ্ছে।

একটি ছোট্ট শিশু তার জোয়ান রোজগেরে ছেলেদের অকালমৃত্যু ভুলিয়েছে। একটা দিনের জন্যও সে তার দুঃখ ভুলেছে। তার অনাহারী ছেলের কথা ভুলেছে।

প্যাঁকালে যেতে যেতে তার মা-র খুশিমুখ দেখলে, বোনের ছেলেকে নিয়ে গানও শুনল। চোখ তার জলে ভরে এল। তাড়াতাড়ি কাঁধের গামছাটা দিয়ে চোখ দুটো মুছে সে হাসতে হাসতে বার হয়ে পড়ল!

রাজমিস্ত্রিদলের মোনা প্যাঁকালের সুরকি-লাল কোটটার পকেটে ফস করে হাত ঢুকিয়ে বললে, “লে ভাই একটা ‘ছিকরেট’বের কর! বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ, শালা হয়তো এতক্ষন দাঁত খিঁচুচ্ছে।”

প্যাঁকালে পথ চলতে চলতে বলল, “ও গুড়ে বালি রে মনা, ছিকরেট ফুরিয়ে গেছে।” আল্লারাখা তার কাছা খুলে কাছায়-বাঁধা বিড়ির বান্ডিলটা সাবধানে বের করে বললে, “এই নে, খাকি ছিকরেট আছে, খাবি?”

কুড়চে বান্ডিল থেকে ফস করে একটি বিড়ি টেনে নিয়ে, সায়েবদের মতো করে বাম ওষ্ঠপার্শ্বে চেপে ধরে ঠোঁট-চাপা স্বরে বললে, “জিয়াশলাই আছে রে গুয়ে, জিয়াশলাই?”

গুয়ে তার ‘নিমার’ভেতর-পকেট থেকে বারুদ-ক্ষয়ে-যাওয়া ছুরিমার্কো দেশলাইয়ের বাক্সটা বের করে কুড়চের হাতে দিয়ে বললে, “দেখিস, একটার বেশি কাঠি পোড়াসনে যেন। মাত্তর আড়াইটি কাঠি আছে।”

কুড়চে কাঠির ও খোলার দুরবস্থা দেখে বললে, “তুই-ই জ্বালিয়ে দে ভাই, শেষে বলবি, শালা একটা কাঠি নষ্ট করে ফেললে!”

গুয়ের ওদিক দিয়ে মস্ত নাম। ঝড়ের মধ্যেও সে এমনই কায়দা করে দেশলাই ধরাতে পারে যে, কাঠিটা শেষ হয়ে না পোড়া পর্যন্ত নিবে না!

দেশলাইয়ের খোলার ঘষা-বারুদে গুয়ে কৌশলের সঙ্গে আধখানা কাঠিটি নিয়ে একটি ছোট টোকা মেরে জ্বালিয়ে ফেলেই দুই হাতের তালু দিয়ে তার শিখাকে বাতাসের আক্রমণ হতে রক্ষা করে এমন করে কুড়চের মুখের সামনে ধরলে যে, তা দেখবার জিনিস।

বিড়িটা যতক্ষণ না আঙুল পুড়িয়ে ফেললে, ততক্ষণ এ-মুখ ও-মুখ হয়ে ফিরতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সর্দার মিস্তিরির, আর যার বাড়িতে কাজ করছে তার চৌদ্দ-পুরুষের আদ্যশ্রাদ্ধও হতে লাগল।

‘ওমান কাতলি’পাড়ার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল তারা। একটা বিশিষ্ট ঘরের সামনে গিয়েই প্যাঁকালে গান ধরে দিলে:

“কালো শশী রে, বিরহ-জ্বালায় মরি!”

তাকে কিন্তু বেশিক্ষণ বিরহ-জ্বালায় মরতে হল না! বাড়িতে ভিতর থেকে কলসি-কাঁখে একটি কালোকুলো গোলগাল মেয়ে বেরিয়ে এল।

মেয়েটি যেন একখানা চার পয়সা দামের চৌকো পাউরুটি! কিন্তু মোটা সে একটু বেশি রকমের হলেও চোখে-মুখে তার লাবণ্য ছিল অপরিমিত, চোখ দুটি যেন লাবণ্যের কালো জলে ক্রীড়া-রত চটুল সফরী – সদাই ভেসে বেড়াচ্ছে ভুরু জোড়া যেন গাঙ-চিলের ডানা – ওই সফরীর লোভে, চোখের লোভে উড়ে বেড়াচ্ছে।

না-বলা কথার আবেশে পাতলা ঠোঁট দুটি কাঁপছে নিমপাতার মতো।

নাকটি যেন মোহনবাশিঁ। চিবুকের মাঝখানটিতে নাশপাতির মতো ছোট টোল।

শ্রাবণ-রাতের মেঘের মতো চুল।

কিন্তু মুখের ওর এত যেন লাবণ্যকে যেন বিদ্রুপ করেছে ওর বাকি শরীরের স্থূল চৌকো গড়ন।

মেয়েটি মধু ঘরামির। মধু আগে মুসলমান ছিল, এখনও ‘ওমান কাতলি’হয়েছে।

মেয়েটির নাম কুর্শি। বয়স চৌদ্দর কাছাকাছি। দেখে কিন্তু ষোলো-সতেরো বলে ভ্রম হয়। একটু বেশি বাড়ন্ত।

সর্দার মিস্তিরির মিষ্টি আলোচনা তখন দলের মধ্যে এমনই জোরের সঙ্গে চলছিল যে, তারা দেখতেই পেলে না, কখন কুর্শি তাদের কচার বেড়ার ধারে চোখ-ভরা ইঙ্গিত নিয়ে এসে দাঁড়াল এবং প্যাঁকালেও হঠাৎ পিছিয়ে পড়ল।

কিন্তু কথা বলবার তারা সুযোগ পেলে না। পিছনে একটা গোরুর গাড়ি আসছিল – প্যাঁকালে তা খেয়াল করেনি। গাড়ির গাড়োয়ান কিন্তু মেয়েটার গতিবিধি লক্ষ করছিল। কচাগাছের কাছে কলসি নিয়ে সাতজন্ম দাঁড়িয়ে থাকলেও যে জল পাওয়া যায় না, এ তো জানা কথা। গাড়োয়ানটা তার উৎসাহ থামিয়ে রাখতে পারল না। হঠাৎ গেয়ে উঠল :

“ছোঁড়ার মাথায় বাবরি-কাটা চুল,
হায় ছুঁড়িরা মজাইল কুল!”

গান তো নয়, ঋষভ চিৎকার! সে চিৎকারে ছোঁড়া-ছুঁড়ির প্রেম ততক্ষণে হৃদয়দেশ ত্যাগ করে বহু ঊর্ধ্বে উধাও হয়ে গেছে!

প্যাঁকালে অকারণে পাশের রেতো কামারের দোকানে ঢুকে পড়ে। গাড়োয়ান শুনতে পায় এমনই চেঁচিয়ে বললে, “এই! আমার বঁড়শিটা কখন দিবি?”বলা বাহুল্য, কামরাকে সে বঁড়শি গড়তে কোনোদিনই দেয়নি।

ওদিক কুর্শি হঠাৎ কলসি নামিয়ে একটা কচার ডাল ভেঙে পাশের ছাগলটাকে অকারণে দু ঘা কষিয়ে দিয়ে বলতে লাগল, “পোড়ারমুখির ছাগল রোজ রোজ এসে বেগুন গাছ খেয়ে যাবে!”

এখানেও বেগুন গাছের উল্লেখটা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক।

রসিক গাড়োয়ান গান গাওয়ার মাঝে ডাইনের বলদটার ঠেসে ল্যাজ মুচড়ে দিয়ে এবং বামের বলদটার তলপেটে বাম পা-টার সাহায্যে বেশ করে কাতুকুতু দিয়ে, –জিহ্বা ও তালু-সংযোগে জোরে দুটো টোকা মেরে শেষের কলিটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতে লাগল – “ও ছুঁড়িরা মজাইল, হায় ছুঁড়িরা মজাইল কুল।”

যন্ত্রণায় ও কাতুকুতুর ঠেলায় বলীবর্দ যুগল ঊর্ধ্বপুচ্ছ হয়ে ছুট দিল।

প্যাঁকালে একবার হতাশ নয়নে ছাগল-তাড়না-রত কুর্শির দিকে তাকিয়ে দৌড়ে জুড়িদের সঙ্গ নিল। তখনও গাড়ি ছুটছে, কিন্তু গাড়োয়ানের মুখ ফিরে গেছে পিছন দিকে।

গাড়ির ধুলোর ভয়ে দলের ওরা পাশ কাটিয়ে দাঁড়াল। জনাব বলে উঠল “উঃ শালার গলা তো নয়, যেন হাঁড়োল! ও শালা কে রে?”

প্যাঁকালে কটু কণ্ঠে বলে উঠল, “ওই শালা ন্যাড়া গয়লা – শালা গান করছে না তো, যেন হামলাচ্ছে।”

সকলেই হেসে উঠল।

হঠাৎ ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠল, “খড়গ্ পাঁচে!”

অমনই সকলে সম্ভ্রস্ত হয়ে উঠল। যে ওই ইঙ্গিত-বাণী উচ্চারণ করলে তার গা টিপে আর একজন যে ওই ইঙ্গিত-বাণী উচ্চারণ করলে তার গা টিপে আর একজন আস্তে জিঞ্জাসা করলে, “কোথায় রে?”

অদূরে সাইকেল রেখে এক ভদ্রলোক রাস্তার ধারেই একটা অপকর্ম করতে বসে গেছিলেন। সেই দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্যাঁকালে বললে, “উ-ই যে নীল চোঁয়ায়!”

এতক্ষণে ওই অপকর্মরত ভদ্রলোকটি দেখে ফেলেছিলেন, এবং এরাও তাঁকে দেখতে পেয়েছিল।

ওই ভদ্রলোকটির বাড়িতেই এরা রাজমিস্তিরির কাজ করে।

এদেশের রাজমিস্তিরিদের অনেকগুলো ‘কোডওয়ার্ড’ – সাংকেতিক বাণী আছে – যার মানে এরা ছাড়া অন্য কেউ বোঝে না। ‘খড়গ্ পাঁচে’বাবু বা সায়েব আসছে বা দেখছে, আর ‘নীল চোঁয়ায়’ব্যবহৃত হয় ওই অপকর্মটির গূঢ় অর্থে।

এর পরেই দলকে দল হঠাৎ এমন সব বিষয়ে আলোচনা জুড়ে দিলে যা শুনে তাদের অতি নিরীহ চির-দুঃখী জন-মজুর ছাড়া কিছু ভাবা যায় না।

laissez un commentaire

prénom *
Ajouter un nom d'affichage
Email *
Votre adresse email ne sera pas publiée

Ce site utilise Akismet pour réduire les indésirables. En savoir plus sur comment les données de vos commentaires sont utilisées.

fr_FRFrançais