ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ

Any SubtitleJune 29, 2023

[ad_1]

ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ

আমাদের হিন্দুস্থান যেমন কীর্তির শ্মশান, বীরত্বের গোরস্থান, তেমনই আবার তাহার বুক অত্যাচারীর আততায়ীর আঘাতে ছিন্নভিন্ন। সেইসব আঘাতের কীর্তিস্তম্ভ বুকে ধরিয়া স্তম্ভিতা এই ভারতবর্ষ দুনিয়ার মুক্তবুকে দাঁড়াইয়া আজ শুধু বুক চাপড়াইতেছে। অত্যাচারীরা যুগে যুগে যত কিছু কীর্তি রাখিয়া গিয়াছে, এইখানে তাহাদের সব কিছুরই স্মৃতিস্তম্ভ আমাদের চোখে শূলের মতো বাজিতেছে। কিন্তু এই সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়া গেল, যেখানে আমাদের ভাইরা নিজের বুকের রক্ত দিয়া আমাদিগকে এমন উদ্‌বুদ্ধ করিয়া গেল, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের নিহত সব হতভাগ্যেরই স্মৃতিস্তম্ভ বেদনা-শেলের মতো আমাদের সামনে জাগিয়া থাক, ইহা খুব ভালো কথা, – কিন্তু সেই সঙ্গে তাহাদেরই দুশমন ডায়ারকে বাদ দিলে চলিবে না। ইহার যে স্মৃতিস্তম্ভ খাড়া করা হইবে, তাহার চূড়া হইবে এত উচ্চ যে ভারতের যে-কোনো প্রান্ত হইতে তা যেন স্পষ্ট মূর্ত হইয়া চোখের সামনে জাগিয়া ওঠে। এ-ডায়ারকে ভুলিব না, আমাদের মুমূর্ষ জাতিকে চিরসজাগ রাখিতে যুগে যুগে এমনই জল্লাদ কশাই-এর আবির্ভাব মস্ত বড়ো মঙ্গলের কথা। ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ যেন আমাদিগকে ডায়ারের স্মৃতি ভুলিতে না দেয়। ইহার জন্য আমাদেরই সর্বাগ্রে উঠিয়া পড়িয়া লাগিতে হইবে। নতুবা আমরা অকৃতজ্ঞতার বদনামের ভাগী হইব। এই যে আজ আমাদের নূতন করিয়া জাগরণ, এই যে আঘাত দিয়া সুপ্ত চেতনা, আত্মসম্মানকে জাগাইয়া তোলা, ইহার মূল কে? – ডায়ার।

মানুষের, জাতির, দেশের যখন চরম অবনতি হয়, তখনই এইরূপ নরপিশাচ জালিমের আবির্ভাব অত্যাবশ্যক হইয়া পড়ে। মানুষ যখন নিজের প্রকৃতিদত্ত অধিকারের কথা ভুলিয়া যায়, শত বন্ধনের মধ্যে তাহার জীবনের গতি-চাঞ্চল্য হারাইয়া ফেলে, তখন তাহার আর মান-অপমান জ্ঞান থাকে না, প্রভুর দেওয়া দয়ার দানকে গোলামের মতো সে মহা-দান বলিয়া মাথায় তুলিয়া বরণ করিয়া লয় এবং তাহার ভৃত্য-জীবন সার্থক হইল মনে করে। তাহার মন এত ছোটো হইয়া যায়, তাহার আশা এত হেয় ও হীন হইয়া পড়ে যে, সে ভাবিতেও পারে না – যে দান মাথায় করিয়া আজ সে গৌরব অনুভব করিতেছে, যে দানকে সে শিরোপা করিয়া (অভিরুচি অনুসারে কখনও পেছনে নেজুরের মতো জুড়িয়া) মুক্ত-স্বাধীন বিশ্বের কাছে বক্ষ স্ফীত করিয়া বেড়াইতেছে, তাহার দাম এক কথায় ‘পাঁচ জুতি’।

মনুষ্যত্বের অবমাননা ও লাঞ্ছনা শুধু ভিক্ষুকের জাতিই হাসিমুখে নিজেদের গৌরব বলিয়া মানিয়া লইতে পারে। অন্তরে যাহারা ঘৃণ্য নীচ আর ছোটো হইয়া গিয়াছে, আত্মসম্মান-জ্ঞান যাহাদের এত অসাড়-হিম হইয়া গিয়াছে, তাহাদিগকে জাগাইয়া তুলিতে চাই – এই ডায়ারের দেওয়া অপমানের মতো বজ্র-বেদন।

এই ডায়ারের মতো দুর্দান্ত কশাই সেনানী যদি সেদিন আমাদিগকে এমন কুকুরের মতো করিয়া না মারিত, তাহা হইলে কী আজিকার মতো আমাদের এই হিম-নিরেট প্রাণ অভিমান-ক্ষোভে গুমরিয়া উঠিতে পারিত – না, আহত আত্মসম্মান আমাদের এমন দলিত সর্পের মতো গর্জিয়া উঠিতে পারিত? কখনই না। আজ আমাদের সত্যিকার শোচনীয় অবস্থা সাদা চোখে দেখিতে পারিয়াছি এই ডায়ারেরই জন্য। ডায়ারের প্রচণ্ড পদাঘাত, পৈশাচিক খুন-খারাবি আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া আমাদের ঘৃণ্য হীন অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করিয়া দিয়াছে। আরও জানাইয়া দিয়াছে যে, – যে নিষ্ঠীবন মাথায় করিয়া প্রভুর দেওয়া যে চাপরাশ পরিয়া, যে ছিন্ন জুতার মালা গলায় দুলাইয়া আমরা আহাম্মকের মতো দুনিয়ার স্বাধীন জাতিদের সামনে দাঁড়াইয়া – গোলামির ঝুটা গৌরব দেখাইতে গিয়া শুধু হাস্যাস্পদ হইয়াছিলাম, তাহাতে কেহ আমাদের প্রশংসা তো করেই নাই, উলটো, আরও, ‘হট্ যাও গোলাম কা জাত’ বলিয়া অবলীলাক্রমে লাঠির গুঁতো, বুটের টক্কর লাগাইয়াছে। তাহারা স্বাধীন-আজাদ; তাহারা আমাদের এ-হীন নীচতা, এত হেয় ভীরুতা, এমন ঘৃণ্য কাপুরুষতাকে পা দিয়া মাড়াইয়া যাইবে না তো কি মাথায় তুলিয়া লইবে? অন্ধ আমরা, আমাদের অবস্থা দেখিতে পাইতেছিলাম না, – সে অন্ধত্ব ঘুচাইয়া দিয়াছে এই ডায়ার! আমাদের এই নির্লজ্জ কাপুরুষতাকে ভীম পদাঘাতে দূর করিয়া দিয়াছে এই জেনারেল ডায়ার! গোলামের সঙ্গে প্রভুর সম্বন্ধ কীরকম তাহাই সে নির্মম কঠোরভাবে জানাইয়া দিয়াছে। অন্য প্রতারকদের মতো গলায় পায়ে শৃঙ্খল পরাইয়া আদর দেখাইতে যায় নাই সে – সে নারীর সামনে উলঙ্গ করিয়া মেথরের হাতে বেত্র দিয়া তোমার পিঠের চামড়া তুলিয়াছে! গর্দানে পাথর চাপা দিয়া বুকের উপর হাঁটাইয়াছে, তাহাদের পায়ে তোমাদিগকে সিজ্‌দা করাইয়া ছাড়িয়াছে। – আর, তবে তোমরা জাগিতে পারিয়াছ। তোমাদিগকে জাগাইতে চাই এমনই প্রচণ্ড নির্মম কশাই-শক্তি! এত নির্মমভাবে, এমন পিশাচের মতো বেত্রাঘাত না করিলে তোমরা জাগিতে না, তোমরা মা-বোনদের সামনে উলঙ্গ করিয়া হাত-পা বাঁধিয়া পশুর মতো না পিটাইলে তোমাদের আত্মসম্মান-জ্ঞান ফিরিয়া আসিত না! ডায়ারের বুট এমন করিয়া তোমাদের কলিজা মথিত না করিয়া গেলে তোমাদের চেতনা হইত না। তোমার মুখের সামনে তোমার আত্মীয়-আত্মীয়ার মুখে এমনি করিয়া থুথু না দিলে তোমাদের মানব-শক্তি খেপিয়া উঠিত না! – তাই আজ আমরা ডায়ারকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিতেছি, ‘খোদা তোমার মঙ্গল করুন!’ তুমি যে মঙ্গল দিয়া গিয়াছ আমাদের সারা ভারতবাসীকে, তাহা আমরা কখনও ভুলিব না, আমরা নিমকহারামের জাতি নই। নিশ্চয়ই তুলিব তোমার স্মৃতিস্তম্ভ, মহৎ প্রতিহিংসারূপে নয়, প্রতিদান স্বরূপ। আজ আমাদের এ-মিলনের দিনে তোমাকে ভুলিতে তো পারব না ভাই! এই মহামানবের সাগরতীরে ভারতবাসী জাগিয়াছে – বড়ো সুন্দর মোহন মূর্তিতে জাগিয়াছে! সেই তোমার আনন্দের হত্যার দিনে, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হতভাগ্যদের রক্তের উপর দাঁড়াইয়া হিন্দু-মুসলমান দুই ভাই গলাগলি করিয়া কাঁদিয়াছে। দুঃখের দিনেই প্রাণের মিলন সত্যিকার মিলন হয়। আজ আমাদের এ-মিলন যে স্বর্গের উপর ভিত্তি করিয়া নয় ভাই, আজ আমরা পরস্পর পরস্পরকে সমান ব্যথায় ব্যথী, একই মায়ের পেটের ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করিয়াছি। কাঁদিয়াছি – গলা জড়াজড়ি করিয়া কাঁদিয়াছি। – আমাদের ভাইদের খুন-মাখানো সমাধির উপর দাঁড়াইয়া আমরা এক ভাই অন্য ভাইকে চিনিয়াছি, আর বড়ো প্রাণ ভরিয়াই গাহিয়াছি –

আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে,
এমন ঘরের হয়ে পরের মতন
ভাই ছেয়ে ভাই কদিন থাকে!

আজ এসো ডায়ার, আমাদের এই মহামিলনের পবিত্র দৃশ্য দেখিতে তোমাকেও নিমন্ত্রণ করিতেছি। আজ ঈর্ষা-দ্বেষ ভুলিয়া গিয়াছে ভাই, তোমারই জন্য আমাদের বুকের আসন পাতা রহিল।

এসো ভাই হিন্দু‌! এসো ভাই মুসলমান! তোমার আমার উপর অনেল দুঃখ-ক্লেশ, অনেক ব্যথা-বেদনার ঝড় বহিয়া গিয়াছে; আমাদের এ বাঞ্ছিত মিলন বড়ো দুঃখের, বড়ো কষ্টের ভাই! খোদা যখন আমাদের জাগাইয়াছেন, তখন আর যেন আমরা না ঘুমাই। যদি এতটুকু ঘুমের খোমার আসে, তবে যেন এই ডায়ারকে স্মরণ করিয়া আবার আমরা হুংকার দিয়া খাড়া হইতে পারি, ডায়ার-স্মৃতিস্তম্ভের ওই আকাশের মর্মভেদী চূড়া দেখিয়া যেন মনুষ্যত্বের শক্তির সাড়া আমাদের মাঝে গর্জন করিয়া উঠে। আমাদের এ-মিলন যদি মিথ্যা হয়, তবে যেন আমাদিগকে সচেতন করিতে যুগে-যুগে এই ডায়ারের বজ্র বেদনার আবির্ভাব হয়। – আমাদের প্রীতি-বন্ধন অক্ষয় হোক। আমাদের এ-মহামিলন চিরন্তন হোক। আমরা আজ সব সংকীর্ণতা, অতীতের সকলদুঃখ-ক্লেশ ভুলিয়া ভাই-এর কোল বাড়াইয়া দিই। এসো ভাই, আর একবার হাত ধরাধরি করিয়া এই খোলা আকাশের মুক্ত মাঠে দাঁড়াই।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish