ধূমকেতুর পথ

Any SubtitleJune 29, 2023

[ad_1]

‘ধূমকেতু’র পথ

অনেকেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছেন, ‘ধূমকেতু’-র পথ কী? সে কী বলতে চায়? এর দিয়ে কোন্ মঙ্গল আসবে ইত্যাদি।

নীচে মোটামুটি ‘ধূমকেতু’র পথনির্দেশ করছি।

প্রথম সংখ্যায় ধূমকেতুতে ‘সারথির পথের খবর’ প্রবন্ধে একটু আভাস দিবার চেষ্টা করেছিলাম, যা বলতে চাই, তা বেশ ফুটে ওঠেনি মনের চপলতার জন্য। আজও হয়তো নিজেকে যেমনটি চাই তেমনটি প্রকাশ করতে পারব না, তবে এই প্রকাশের পীড়ার থেকেই আমার বলতে-না-পারা বাণী অনেকেই বুঝে নেবেন – আশা করি। পূর্ণ সৃষ্টিকে প্রকাশ করে দেখাবার শক্তি হয়তো ভগবানেরও নেই, কোনো স্রষ্টারই নেই। মানুষ অপ্রকাশকে আপন মনের পূর্ণতা দিয়ে পূর্ণ করে দেখে।

সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।

স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথি এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ-দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনও। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।

পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।

আর এই বিদ্রোহ করতে হলে – সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে, – আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ!

বলতে হবে, – যে যায় যাক সে, আমার হয়নি লয়!

কথাটা শুনতে হয়তো একটু বড়ো রকমের হয়ে গেল। একটু সহজ করে বলবার চেষ্টা করি। আর এইটাই ধূমকেতুর সবচেয়ে বড়ো বলা।

আমি যতটুকু বুঝতে পারি, তার বেশি বুঝবার ভান করে যেন কারুর শ্রদ্ধা না প্রশংসা পাওয়ার লোভ না করি। তা সে মহাত্মা গান্ধিরই মতো হোক আর মহাকবি রবীন্দ্রনাথেরই মতো হোক কিংবা ঋষি অরবিন্দেরই মতো হোক, আমি সত্যিকার প্রাণ থেকে যতটুকু সাড়া পাই রবীন্দ্র, অরবিন্দ বা গান্ধির বাণীর আহ্বানে, ঠিক ততটুকু মানব। তাঁদের বাণীর আহ্বান যদি আমার প্রাণে প্রতিধ্বনি না তোলে, তবে তাঁদের মানব না। এবং এই ‘মানি না’ কথাটা সকলের কাছে মাথা উঁচু করে স্বীকার করতে হবে। এতে হয়তো লোকের অনেক নিন্দা-বদনাম-অপবাদ শুনতে হবে, কিন্তু আমি আমার কাছে ঠিক থাকব। তাঁদেরে বা তাঁদের মতো ঠিক না বুঝেও যদি লোকের কাছে বলে বেড়াই যে, আমি গান্ধি-ভক্ত বা রবীন্দ্র-ভক্ত বা অরবিন্দ-ভক্ত, তাতে অনেকের শ্রদ্ধা-প্রশংসা লাভ করব, কিন্তু আসলে তো সেটা ফাঁকি দিয়ে নেওয়া। এতে অন্যকে প্রবঞ্চনা করে খুব বাহবা নিতে পারি, কিন্তু আমার অন্তরের দেবতা অর্থাৎ আমার আমি তো তাতে দিন দিন ক্লিষ্ট-পীড়িতই হয়ে উঠবে। অন্যায় করলে, পাপ করলে অন্তরে যে পীড়া উপস্থিত হয়, মানুষের সেইটুকুই সচেতন ভগবান, সেইটুকুই সত্য।

সকলেরই অন্তরে এমন একটা কিছু আছে, যেটা মিথ্যা সইতে পারে না। তা নিজেরই হোক আর পরেরই হোক। সেটাকে সব সময় হয়তো জিদের বশে স্বীকার করি না, কিন্তু নিজেকে তো আর ফাঁকি দেওয়া চলে না। যখন ফাঁকি দিয়ে লোকের কাছ থেকে বাহবা নিয়ে ঘরে ফিরি, তখন আমার ওই বাহবা অর্জনের ফাঁকির কথা মনে হয়ে প্রাণে যেন কেমন এক অসোয়াস্তি কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। ওই অসোয়াস্তিই হচ্ছে অনুশোচনা বা অনুতাপ। যাকে সদাসর্বদা তার কৃতকর্মের বা হঠকারিতার জন্য এই রকম অনুশোচনা বা অনুতাপের তুষানলে দগ্ধ হতে হয়, সে ক্রমেই ভীরু, কাপুরুষ হয়ে যেতে থাকে, সে তখন বাক-সর্বস্ব হয়ে ওঠে ফোঁপরা ঢেঁকির মতো। তার দিয়ে আর কোনোদিন কোনো বড়ো কিছুর আশা করা যায় না। আমাদের সকালের মধ্যে নিরন্তর এই ফাঁকির লীলা চলেছে। এই বাংলা হয়ে পড়েছে ফাঁকির বৃন্দাবন। কর্ম চাই সত্য, কিন্তু কর্মে নামবার বা নামাবার আগে এই শিক্ষাটুকু ছেলেদেরে, লোকেদেরে রীতিমতো দিতে হবে যে, তারা যেন নিজেকে ফাঁকি দিতে না শেখে, আত্মপ্রবঞ্চনা করে করে নিজেকেই পীড়িত করে না তোলে।

আমি জীবনে অনেক আত্মপ্রবঞ্চনা করে করে অন্তরে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করেছি, কত রাত্রি অনুশোচনায় ঘুম হয় নাই। এখন সে-সব ভুল বুঝতে পেরেছি। এখন সোজা এই বুঝেছি যে, আমি যা ভালো বুঝি, যা সত্য বুঝি, শুধু সেইটুকু প্রকাশ করব, বলে বেড়াব, তাতে লোকে নিন্দা যতই করুক, আমি আমার কাছে আর ছোটো হয়ে থাকব না, আত্ম-প্রবঞ্চনা করে আর আত্মনির্যাতন ভোগ করব না।

যাঁকে আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে, তাঁকে বুঝবার ভান করলে তাঁকে অপমানই করা হয়। কারণ, পূজা মানে দেবতাকে সত্যি করে চিনে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া। যাঁকে আমি সত্য করে বুঝতে পারিনি, তাঁকে পূজা করতে যাওয়া মানে তাঁর অপমান করা। মিথ্যা মন্ত্রের উচ্চারণে দেবতা পীড়িতই হয়ে ওঠেন দিন দিন, প্রসাদ দেন না।

কিন্তু মানুষের এমনই দুর্বলতা যে, এই শ্রদ্ধা-প্রশংসা পাওয়ার লোভটুকুকে কিছুতেই সে জয় করতে পারছে না। সমাজে থেকে সমাজের শ্রদ্ধা লাভের জন্য তাকে জেনে-শুনে অনেক মিথ্যা আচরণ করতে হয়। ‘ধূমকেতু’ এখন এইটুকু প্রচার করতে চায় যে, দেশ-উদ্ধারের জন্য যারা সৈনিক হতে চায়, অন্তত তারা যেন সর্বাগ্রে এই দুর্বলতা, এই লোভটুকু জয় করবার ক্ষমতা অর্জন করে তবে কোনো কাজে নামে। সত্যিকার প্রাণ না নিয়ে কাজে নামলে তাতে কাজ পণ্ডই হয় বেশি।

অনেকেই লোভের বা নামের জন্য মহাত্মা গান্ধির অহিংস আন্দোলনে নেমেছিলেন। কিন্তু আত্ম-প্রবঞ্চনা নিয়ে নেমেছিলেন বলে অন্তর থেকে সত্যের জোর পেলেন না, আপনি সরে পড়লেন। রবীন্দ্র-অরবিন্দ-ভক্তদের মধ্যেও ওই একই প্রবঞ্চনা-ফাঁকি এসে পড়েছে। এরা অন্ধভক্ত, চোখওয়ালা ভক্ত নয়, বীর-ভক্ত নয়। এরা বুঝেও বোঝে না যে, পূজার নামে এরা তাঁদেরে অপমান করছে, বড়ো করবার নামে তাঁদেরে লোকচক্ষুতে আরও খাটোই করে তুলছে। এদের এতটুকু দুঃসাহস নেই যে, যেটুকু বুঝতে পারছে না সেটুকু ‘বুঝতে পারছিনি’ বলে বুঝে নিতে, পাছে তাঁর গুরুর কাছে সে কম বুদ্ধিমান হয়ে পড়ে বা গুরুর রোষদৃষ্টিতে পড়ে। এ-সব অন্ধলোক দিয়ে কোনো কাজ হবে না। কেননা, অন্তরে মিথ্যা আর ফাঁকি নিয়ে কাজে নামলে কাজেও মস্ত ফাঁক পড়ে যায়। যাঁকে বুঝি না, যাঁর মত বুঝতে পারি না, তাঁর মুখের সামনে মাথা উঁচু করে বলতে হবে যে, আপনার মত বুঝতে পারছিনে বা আপনার এ-মত এই-এই কারণে ভুল। তাতে যিনি সত্যকার দেবতা, তিনি কখনই রুষ্ট হবেন না, বরং তোমার সরলতা ও সত্যপ্রিয়তার দুঃসাহসিকতার জন্য শ্রদ্ধাই করবেন। বিদ্রোহ মানে কাউকে না-মানা নয়, বিদ্রোহ মানে যেটা বুঝি না, সেটাকে মাথা উঁচু করে ‘বুঝি না’ বলা। যে-লোক তার নিজের কাজের জন্য নিজের কাছে লজ্জিত নয়, সে ক্রমেই উচ্চ হতে উচ্চতর স্তরে স্বর্গের পথে উঠে চলবেই চলবে। আর যাকে পদে পদে তার ফাঁকি আর মিথ্যার জন্য কুণ্ঠিত হয়ে চলতে হয়, সে ক্রমেই নীচের দিকে নামতে থাকে, এইটাই নরক-যন্ত্রণা। আমার বিশ্বাস, আত্মার তৃপ্তিই স্বর্গসুখ। আর আত্মপ্রবঞ্চনার পীড়াই নরক-যন্ত্রণা। ‘ধূমকেতু’র মত হচ্ছে এই যে, তোমার মন যা চায়, তাই করো।

ধর্ম, সমাজ, রাজা, দেবতা কাউকে মেনো না। নিজের মনের শাসন মেনে চলো। গান্ধির মত যদি প্রাণ থেকে না মানতে পার, বাস্, লোকের নিন্দা-বদনামের ভয়ে তা মেনো না, রবীন্দ্র-অরবিন্দের মত ঠিক মেনে নিতে পারছ না, বাস, মাথা উঁচু করে বলো, ‘বুঝতে পারছি না’। অন্ধ-ভক্তির অন্ধতায় যা বোঝ না তা, ‘বুঝি না’ বলো, দেখবে অপূর্ব তৃপ্তি-পুলকে আত্মা তোমার কানায় কানায় ভরে উঠছে। তখন নিন্দা-অপমান তোমার গায়ে লাগবে না। নিজে যতটুকু ভালো মনে কর, করো, তার চেয়ে মুক্তি আর নেই প্রাণের। ইংরেজের সহযোগিতা করে যদি দেশ উদ্ধার হবে তুমি প্রাণ হতে নিজকে ফাঁকি না দিয়ে বিশ্বাস কর, তবে তাই করো, কারুর নিন্দা ও অপবাদকে ভয় কোরো না। কিংবা যদি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করলে দেশের মুক্তি হবে না মনে কর, তাই বলো বুক ফুলিয়ে। অত্যাচারীকে অত্যাচারী বলো। তাতে আসে আসুক বাইরের নির্যাতন, ইংরাজের মার, তাতে তোমার অন্তরের আত্মপ্রসাদ আরও বেড়েই চলবে!

মিথ্যাকে মিথ্যা বললে, অত্যাচারীকে অত্যাচারী বললে যদি নির্যাতন ভোগ করতে হয়, তাতে তোমার আসল নির্যাতন ওই অন্তরের যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। প্রাণের আত্মপ্রসাদ যখন বিপুল হয়ে ওঠে, তখন নির্যাতকের আগুন ওই আনন্দের এক ফুঁতে নিবে যায়। ইব্রাহিম যখন বিদ্রোহী হয়ে নমরুদের অত্যাচারকে অত্যাচার আর তার মিথ্যাকে মিথ্যা বলে প্রচার করে বেড়াতে লাগলেন, তখন নমরুদ তাঁকে ধরে এক বিরাট অগ্নি-জাহান্নমের সৃষ্টি করে তাতে নিক্ষেপ করলে। কিন্তু ইব্রাহিমের কোথাও ফাঁকি ছিল না বলে, সত্যের জোর ছিল বলে তাঁর আত্মপ্রসাদ ওই বিপুল আনন্দের এক ফুঁতে সমস্ত জাহান্নম ফুল হয়ে হেসে উঠল। ইব্রাহিমের মনে যদি এতটুকু ফাঁকি থাকত, তবে তখনই নমরুদের আগুন তাঁকে ভস্মীভূত করে দিত।

ভগবানের বুকে লাথি মারবার অসমসাহসিকতা নিয়ে বেরিয়েছিলেন মহাবিদ্রোহী ভৃগু। কেননা সে তাঁকে বোঝেনি, তাঁর ভুলকে ভুল বলে শোধরাবার চেষ্টা করেছিল, ভগবান যখন তা শুনলেন না, ঘুমিয়ে রইলেন তখন ভৃগু ভগবানের বুকে লাথি মেরে জাগালে। ভগবানও ভৃগুর পদ-চিহ্ন সগৌরবে বক্ষে ধারণ করলেন। ভাবতে চক্ষে জল আসে। কিন্তু ভগবানের যারা বিদ্রোহী নয়, গো-বেচারি ভক্ত, ভগবানকে প্রভু ভেবে জনম-জনম কাটিয়ে দিলে সাধনায়, তাদেরে হয়তো সিদ্ধি তিনি দিলেন, কিন্তু তাদের কারুর পদাঘাতকে তো বুকে ধারণ করে দেখালেন না। এর আসল মানে হচ্ছে, সত্যকে জানবার যার বিপুল সত্য ইচ্ছা থাকে, তার আঘাতও সহ্য করে, বুকে করে নিয়ে তার সত্য-নিষ্ঠা, সত্য জাগাবার আকাঙ্ক্ষাকে জগতের ভীরু কাপুরুষ ভণ্ড-ভক্তদের চোখের সামনে দেখায় যে, এই ফাঁকির পূজারির ক্রন্দনে সত্য জাগে না। সত্যকে জাগাবার জন্য বিদ্রোহ চাই, নিজেকে শ্রদ্ধা-প্রশংসার লোভ থেকে রেহাই দেওয়া চাই।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish