পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?

Any SubtitleJune 29, 2023

[ad_1]

পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?

‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’

বনানী-কুন্তলা ষোড়শী বনের বুক চিরে বেরিয়ে এসে পথ-হারা পথিককে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’

সেদিন দিশেহারা পথিকের মুখে উত্তর জোগায়নি। সুন্দরের আঘাতে পথিকের মুখে কথা ফোটেনি।

পথিক সেদিন সত্যই পথ হারিয়েছিল।

হে আমার গহন-বনের তরুণ-পথিক দল! আজ সেই বনানী-কুন্তলা ভৈরবী-সূতা আবার বনের বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে – চোখে তার অসংকোচ দৃষ্টির খড়্গ-ধার, ভালে তার কাপালিকের আঁকা রক্ত-তিলক, হাতে তার অভয় তরবারি – সে আবার জিজ্ঞাসা করছে – ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’

উত্তর দাও, হে আমার তরুণ পথ-যাত্রী-দল! ওরে আমার রক্ত-যজ্ঞের পূজারি ভায়েরা! বল, তোরাও কি আজ সৌন্দর্যাহত রূপ-বিমূঢ় পথহারা পথিকের মতো মৌন নির্বাক চোখে ওই ভৈরবী রূপসির পানে চেয়ে থাকবি? উত্তর দে মায়ের পূজার বলির নির্ভীক শিশু!

বল, ‘মাভৈঃ! আমরা পথ হারাই না! আমাদের পথ কখনও হারায় না। বল, আমাদের এ-পথ চির-চেনা পথ – এই বনের বুকে রক্ত-আঁকা পথ।’

বল, ওরে রক্ত-পথের পথিক! ‘এই বনের পথই আমাদের চির চেনা পথ। হাটের পথিকের পায়ে-চলার পথ আমাদের জন্য নয়। সিংহ-শার্দূল-শঙ্কিত কণ্টক-কুণ্ঠিত বিপথে আমাদের চলা। ওগো ভৈরবী মেয়ে! এ রক্ত-পথিকের দল, নবকুমারের দল নয়।’

ভৈরবী রূপসি আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’

এবার বল আমার বন্য তরুণ দল, ‘ওগো, আমরা পথ হারাইয়াছি, ঘরের পথ হারাইয়াছি, বনের পথ হারাই নাই।’

অকুণ্ঠিতা অনবগুণ্ঠিতা বন-বালার চোখে কুণ্ঠার ছায়াপাত হোক, পরাজয়ের লাজ-অবগুণ্ঠন পড়ুক!

নিবিড় অরণ্য। তারই বুকে দোলে, দোলে, মহিরুহ সব দোলে – বনস্পতি-দল দোলে – লতা-পাতা সব দোলে! দোলে তারা সবুজ খুনের তেজের বেগে। তারই মাঝে চলে – চলে আমার বন্য-হিংস্র বীরের দল। তাদেরে পথ দেখায় কাপালিকের রক্ত-তিলক পরা ভৈরবী মেয়ে।

অদূরে কাপালিকের রক্ত-পূজার মন্দির। মন্দিরে রক্ত-ভুখারিনির তৃষ্ণাবিহ্বল জিহ্বা দিয়ে টপটপ করে পড়ছে কাঁচা খুনের ধারা। দূরে হাজার কণ্ঠের ভৈরব-গান শোনা গেল –

তিমির হৃদয়-বিদারণ জলদগ্নি নিদারুণ।
জয় সঙ্কট সংহর। শঙ্কর। শঙ্কর।

রক্ত-পাগলি বেটির পায়ের চাপে শিব আর্তনাদ করে উঠল। রক্ত-মশাল করে ভৈরবপন্থীর কণ্ঠ শোনা গেল আরও কাছে –

বজ্র-ঘোষবাণী, রুদ্র শূলপাণি,
মৃত্যু-সিন্ধু-সন্তর। শঙ্কর! শঙ্কর!!

আবার শিব মোচড় খেয়ে উঠল, কিন্তু শব তার বুকে চেপে।

মন্দির থরথর করে কাঁপতে লাগল। উলসিত বনানী ঝড়ের ফুঁ দিয়ে নাচতে লাগল।

কাপালিকের রক্ত-আঁখি দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। আর দেরি নাই, ওই আসে রক্ত-পূজার বলি। ছেড়ে দে বেটি, ছেড়ে দে শিবকে, কল্যাণকে উঠে দাঁড়াতে দে।

ইন্দ্রের বজ্রে ঘন ঘন শঙ্খধ্বনি হতে লাগল।

মেঘ-ডম্বরুতে বোধনের বাজনা বাজতে লাগল।

বিজলি মেঘের বজ্র-কড়া-নাড়ার মতো বাইরে দস্যি মেয়ে কড়কড় করে কড়া নেড়ে হেঁকে উঠল, ‘দোর খোলো, পূজা এসেছে।”

বাইরে ঝড়ের দোলার তালে তালে ভৈরবপন্থীর দল নাচতে লাগল –

কী আনন্দ কী আনন্দ কী আনন্দ,
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।

ঝনঝন শব্দে মন্দির দ্বার খুলে গেল। কাপালিক বেরিয়ে এল, নয়নে তার দারুণ হিংসা-বহ্নি, স্কন্ধে তার বিজয়-কৃপাণ। মন্দিরের অঙ্গনে নৃত্য চলতে লাগল –

‘তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ’। ভৈরবী হাঁকালে, ‘আর দেরি কী?’

* * *

বনানী তেমনই দোলে – দোলে – দোলে। একটা কাতরানি, একটা ব্যথিতার ক্রন্দনের মতো কী যেন দোলে – দোলে বনানীর পাগলামিতে।

কখন পূজা শেষ হয়ে গেছে। কখন ঘন্টা বাজল, কখন বলি দেওয়া হল, তা কেউ জানলে না। শুধু মন্দিরের শুভ্র বেদি রক্তে ভেসে গেছে। শব-পাগলি বেটির চরণ শিবের বুক থেকে শিথিল হয়ে যেন নামতে চাইছে। বেটির পায়ে একরাশ কাঁচা হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে, যেন সদ্য-ছিন্ন রক্ত-জবার জীবন্ত কাতরানি।

একরাশ ছিন্ন-মুণ্ড খেপী বেটির পানে ছলছল চোখে তখনও তাকাচ্ছে।

আকাশ থেকে অগ্নিরথ নেমে এল। বলিদানের তরুণরা তাতে চড়ে যখন ঊর্ধ্বে – ঊর্ধ্বে – আরও ঊর্ধ্বে উঠে যেতে লাগল, তখন বন্য মেয়ে কাপালিক-কন্যারও দুই গণ্ড বেয়ে টসটস করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে করুণ-কণ্ঠে আর একবার জিজ্ঞাসা করল, – ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’ তারপর শঙ্করী বেটির রক্ত-মাখা পায়ে লুটিয়ে পড়ল। কাপালিকের খড়্গ আর একবার নৃত্য করে উঠল। ভৈরবী শুধু বললে, ‘মা!’

এবার করালী বেটির অশ্রুহীন চোখেও অশ্রুপুঞ্জ দুলে উঠল।

ততক্ষণে অগ্নিরথ-যাত্রীদলের উত্তর ভেসে এল, ‘পথ হারাই নাই দেবী! ওই খড়্গ-চিহ্নিত রক্ত-পথই শিব জাগাবার পথ।’

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish