মৃত্যুক্ষুধা – ০৫

Any SubtitleJune 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ০৫

সন্ধে হব-হব সময় প্যাঁকালে হাতে চাল-ডাল, বগলতলায় ফুটগজ, পকেটে কন্নিকসুত, আর মুখে পান ও বিড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকল।

ছেলেমেয়ে তাকে যেন ছেঁকে ধরল।

চাল-ডালের মধ্যে একটা বোয়াল মাছ দেখে তারা একযোগে চিৎকার করে উঠল। যেন সাপের মাথায় মানিক দেখেছে।

প্যাঁকালে তার কোটের হাতায় হাত দুটো মুছে তিনটে ছোট্ট কাগজের পুরিয়া বের করে বললে, “আজ নলিত ডাক্তারের বাড়ির খানিকটা পলস্তারা করে দিয়ে এই ওষুধ নিয়ে এসেছি সোজা-ভাবির তরে। দাঁড়া, এক পুরিয়া খাইয়ে দিই আগে।”

সেজোবউ ওষুধ দেখে খুশি হয়ে বলে উঠল, “ই কোন ওষুধ ছোটো-মিয়েঁ? এলোপাতাড়ি না হৈমুবাতিক?”

প্যাঁকালে বিজ্ঞতার হাসি হেসে বললে, “ই এলিওপাতি নয় সেজো-ভাবি, হোমিওবাতি। গুড়ের মতো মিষ্টি। খেয়েই দেখো।”

ওষুধ খেয়ে সেজোবউয়ের মনে হতে লাগল, সে যেন ক্রমেই চাঙ্গা হয়ে উঠছে। সে তার খুশি আর চেপে না রাখতে পেরে বলতে লাগল, “আর দুটো দিন যদি ওষুধ পাই মেজোবুবু, তাহলে আসছে-মাস থেকেই আমি একা একরাশ ধান ভানতে পারব।”

মেজোবউ চাল-ডাল তুলতে তুলতে বললে, “ তাই ভালো হয়ে ওঠ ভাই আল্লা করে, আমি আর পারি না ঢেঁকিতে পাড় দিতে। আমার কাপড় সেলাই-ই ভালো, ওতে দু পয়সা কম পেলেও সোয়াস্তি আছে।”

বড়োবউ বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে তার ঘুঁটে-দেওয়া হাতের গোবর চেঁছে তুলতে তুলতে বললে, “ওই সেলাইটা আমায় শিখিয়ে দিতে পারিসনে মেজোবউ! তবে রিপু করাটা কিন্তু আমায় দিয়ে হবে না।”

মেজোবউ হাসে, আর গুন গুন করে গান করতে করতে মাছ কোটে। ছেলেমেয়েদের দল মেজোবউকে ঘিরে হাঁ করে মাছ কোটা দেখে আর কে মাছের কোন অংশটা খাবে, এই নিয়ে কলহ করে। যেন কাঁচাই খেয়ে ফেলবে ওরা।

বড়ো ছেলেমেয়ে দুটোতে মিলে ইঁদারায় জল তুলে দিতে দিতে বলে, “আচ্ছা ছোটো চাচা, আজ মাছের মুড়োটা তো তুমিই খাবে? পটলি বলছিল, ছোটো-চা আজ আমায় দেবে মুড়োটা!”

প্যাঁকালে স্নান করতে করতে কী ভাবে! শুধু বলে, ‘হুম’!

তার এই ‘হুঁ’ শুনে ছেলেটি আতঙ্কিত হয়ে উঠে বলে, “আচ্ছা ছোটো-চা, আমাকে কাল থেকে ‘জোগাড়’ দিতে নিয়ে যাবে? উ-ই ও পাড়ার ভুলো তো আমার চেয়ে অনেক ছোটো, সে রোজ দু আনা করে আনে ‘জোগাড়’দিয়ে। – আচ্ছা ছোটো-চা, দু আনায় একটা মাছ পাওয়া যায় না?” – তারপর তার বোনের দিকে তাকিয়ে বলে, “কাল থেকে আমার একা একটা মাছ! দেখাব আর খাব! ওই পটলিকে যদি একটা আঁশ ঠেকাই তবে আমার নাম গোরাই নয়, হুঁ হুঁ।”

তার বোন মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে কী একটা মতলব ঠাওরায়। তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, “আমিও কাল থেকে দারোগা সায়েবের খুকির গাড়ি ঠেলব – হুঁ হুঁ! আমায় সায়েব তিন ট্যাকা করে মাইনে দেবে বলেছে! দু আনা লয় – তিন ট্যাকা। আমিও তখন ছোটো-টাকে দিয়ে জিলিবি আর মেঠাই আনাব!”

প্যাঁকালে স্নান সেরে তার বোনের আঁতুড়-ঘরে ঢুকে বললে, “কই রে পাঁচি, তোর ছেলে দেখা!”

পাঁচি কিছু বলবার আগেই ওর মা ছুটে এসে বললে, “হ্যাঁরে প্যাঁকালে, শুধু হাতে দেখবি কী করে!”

প্যাঁকালে নিজের রিক্ততায় সংকুচিত হয়ে বলে উঠল, “আচ্ছা, কাল কিংবা আর একদিন দেখব এসে। আমার – শালা – মনেই ছিল না যে, শুধু হাতে দেখতে নেই।” বলেই সে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে মেজোবউয়ের কাছে গিয়ে বসল।

মাছটা চড়িয়ে দিয়ে তখন মেজোবউ ভাতের ফ্যান গালছিল। এধার ওধার একটু চেয়ে নিয়ে সে বললে, “সেজোবউ কিন্তু বাঁচবে না ছোটো-মিয়েঁ!” বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগল, “ওরা মায়েপোয়েই যাবে এবার। আজ সারাদিন যা করেছে ছেলেটা! মায়ের বুকে এক ফোঁটা দুধ নাই, আজ এই সব হাঙ্গামে আবার ছাগলটাও ছেড়ে ফেলেছিলাম। ওই ছাগলের দুধই তো বাছার জান! একটুকু দুধের জন্য ছেলেটা যেন ডাঙার মাছের মতো তড়পেছে! তবু ভাগ্যিস, দারোগা সায়েবের বিবি একটুকু দুধ দিয়েছিল। তারই একটুকু রেখেছিলাম, কিন্তু ছেলে তার দু চামচের বেশি খেলে না। কেঁদে কেঁদে এই একটু ঘুমিয়েছে।” বলেই ভাতের হাঁড়িতে ঝাঁকানি দিয়ে ভাতগুলো উলটে নিয়ে মুখের সরাটা একটু ফাঁক করে পাশে রেখে দিল।

প্যাঁকালে কিছু না বলে আস্তে আস্তে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish