মৃত্যুক্ষুধা – ১২

Any SubtitleJune 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ১২

একদিকে মৃত্যু, একদিকে ক্ষুধা।

সেজোবউ আর তার ছেলেকে বাঁচাতে পারা গেল না। ওর শুশ্রূষা যেটুকু করেছিল সে শুধু ওই মেজোবউ আর ওষুধ দিয়েছিল মেম সায়েব – রোমান ক্যাথলিক মিশনারি।

মেজোবউ সেজোর রোগ-শিয়রে সারারাত জেগে বসে থাকে। কেরোসিনের ডিবে ধোঁয়া উদগিরণ করে ক্লান্ত হয়ে নিবে যায়। অন্ধকারে বন্ধুর মতো জাগে একা মেজোবউ। আর পাথরের মতো স্থির হয়ে দেখে, কেমন করে একজন মানুষ আর একজন অসহায় মানুষের চোখের সামনে ফুরিয়ে আসে।

সেজোবউ তার ললাটে মেজোবউয়ের তপ্ত হাতের স্পর্শ-ছোঁয়ায় চকিত হয়ে চোখ খোলে। বলে, “এসেছ তুমি?” তারপর শিয়রে মেজোবউকে দেখে ক্ষীণ হাসি হেসে বলে, “মেজো-বু, তুমি বুঝি? তোমার সব ঘুম বুঝি আমার চোখে ঢেলে দিয়েছ?”

মেজোবউ নত হয়ে সেজোর চোখে চুমু খায়। সেজো মেজোবউয়ের হাতটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলে, “মেজো-বু, তুমি কাঁদছ?” –তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “কাঁদো মেজো-বু, মরার সময়েও তবু একটু দেখে যাই, এই পোড়ামুখির জন্যেও কেউ কাঁদছে। দেখো মেজো-বু, তুমি আমার জন্য কাঁদছ, আর তাই দেখে আমার এত ভালো লাগছে – সে আর কি বলব। ইচ্ছে করছে বাড়ির সব্বাই যদি আমার কাছে বসে এমনই করে কাঁদে, আমি তাহলে হেসে মরতে পারি। হয়তো বা বেঁচেও যেতে পারি। কিন্তু মেজো-বু, আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এই ছেলের ভাবনা? ওর মায়া কাটিয়েছি! কাল ওর বাবাকে দেখেছিলুম ‘খোয়াবে’, বললে, ‘খোকাকে নিতে এসেছি।’আমি বললুম, ‘আর আমায়?’সে হেসে বললে, ‘তোকে নয়।‘আমি কেঁদে বললুম, ‘যম তো নেবে, তুমি না নাও’!”

মেজোবউ কান্না-দীর্ণ কণ্ঠে বলে, “চুপ করে ঘুমো সেজো, তোর পায়ে পড়ি বোনটি!”

সেজো মেজোবউয়ের হাতটা গালের নীচে রেখে পাশ ফিরে শোয়। বলে, “কাল তো আর আসব না মেজো-বু কথা বলতে। ঘুমোব বলেই তো কথা কয়ে নিচ্ছি। এমন ঘুমুব যে, হু –ই ‘গোদা ডাঙায়’গিয়ে রেকে আসবে তিনগাড়ি মাটি চাপা দিয়ে। যেন ভূত হয়েও আর ফিরে আসতে না পারি!.. দেখো মেজো-বু, কাল সে যদি শুধু খোকাকে নিতে আসত, তাহলে কি হাসতে পারত অমন করে? আমায়ও নিয়ে যাবে, ও চিরটাকাল আমার সঙ্গে অমনই দুষ্টুমি করে কথা কয়েছে!…তোমার মনে আছে মেজো-বু, মরার আধঘন্টা আগেও আমায় কেমন করে বললে, ‘আমার সামনে তুই যদি এক্ষুনি মরিস, তাহলে আমার মরতে এত কষ্ট হয় না!…”

শিয়রে প্রদীপ নিবু-নিবু হয়ে আসে। শুধু মেজোবউয়ের চোখ ভোর আকাশের তারার মতো চোখের জলে চিকমিক করে। বলে, “সেজো, তোর কিছু ইচ্ছে করছে এখন?”

সেজো ধীর শান্তস্বরে বলে, “কিচ্ছু না। আর এখন কোনো কিছু পেতে ইচ্ছে করে না মেজো-বু! কাল পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, যদি একটু ভালো খাবার-পথ্যি পেতুম –তাহলে হয়তো বেঁচে যেতুম। খোকার মুখে তার মায়ের দু-ফোঁটা দুধ পড়ত। আর তো পাবে না বাছা আমার!” বলেই ছেলের গালে চুমু খায়।

একটা আঁধার রাত যেন ডাইনির মতো শিস দিয়ে ফেরে। গাছপালা ঘরবাড়ি–-সব যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে থাকে। তারাগুলোকে দেখে মনে হয় সহস্র হতভাগিনির শিয়রে নিবু-নিবু পিদিম।

এরই মাঝে মাটির ঘরের মাটির শেজে শুয়ে একটি মানুষ নিবতে থাকে রিক্ত-তৈল মৃৎ-প্রদীপের মতো। তেল ওর ফুরিয়ে গেছে, এখন সলতেতে আগুন ধরেছে। ওটুকুও ছাই হতে আর দেরি নেই।

সেজো মেজোবউয়ের হাতটা বাঁ-বুকে জোরে চেপে বলে, “দেখছ, মেজো-বু, বুকটা কীরকম ধড়ফড় করছে। একটা পাখিকে ধরে খাঁচায় পুরলে সে যেমন ছটফট করে বেরোবার জন্যে, তেমনই, না? উঃ! আমার যেন দম আটকে আসছে! মেজো-বু! বাইরে কি এতটুকুও বাতাস নেই?”

মেজোবউ জোরে জোরে পাখা করে।

সেজো মেজোবউয়ের পাখা-সমেত হাতটা চেপে ধরে, “থাক, থাক! ও বাতাসে কি আর কুলোয় মেজো-বু? সব সইত আমার, সে যদি পাশে বসে থাকত! আমি চলে যাচ্ছি দেখে সে খুব করে কাঁদত, তার চোখের পানিতে আমার মুখ যেত ভেসে!” আর বলতে পারে না। কথা আটকে যায়। মুখ দিয়ে নিশ্বাস নেয়।

খোকা কেঁদে ওঠে। মেজোবউ কোলে নিয়ে দোলা দেয়, ছড়া গায় –“ঘুম আয়োরে নাইলো তলা দিয়া, ছাগল-চোরায় যুক্তি করে খোকনের ঘুম নিয়া।”

ভোরের দিকে সেজোবউ ঢুলে পড়তে লাগল মরণের কোলে। মেজোবউ কাউকে জাগালে না। সেজোর কানে মুখ রেখে কেঁদে বললে, “সেজো! বোনটি আমার! তুই একলাই যা চুপটি করে। তোর যাওয়ার সময় আর মিথ্যে কান্নার দুখ্যু নিয়ে যাসনে!”

সেজো শুনতে পেলে কিনা, সে-ই জানে। শুধু অস্ফুটস্বরে বললে, “খোকা…তুমি…”

মেজোবউ সেজোর দুই ভুরুর মাঝখানটিতে চুমু খেয়ে বললে, “ওকে আমি নিলাম সেজো, তুই যা তোর বরের কাছে। আর পারিস তো আমায় ডেকে নিস!”

মেজোবউ আর থাকতে পারল না –ডুকরে কেঁদে উঠল।

দূরে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভোরের নামাজের আহ্বান শোনা যাচ্ছিল –“আসসালাতু খায়রুম মিনান্নৌম। – ওগো জাগো! নিদ্রার চেয়ে উপাসনা ঢের ভালো। জাগো!”

মেজোবউ দাঁতে দাঁত ঘষে বললে, “অনেক ডেকেছি আল্লা, আজ আর তোমায় ডাকব না।”

সেজোর মুখ কিন্তু কী এক অভিনব আলোকোচ্ছ্বাসে আলোকিত হয়ে উঠল। সে প্রাণপণ বলে দুই হাত তুলে মাথায় ঠেকালে – মুনাজাত করার মতো করে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গেল –কিন্তু তা তক্ষুনি ছিন্নলতার মতো এলিয়ে পড়ল তার বুকে।

মেজোবউ মুগ্ধের মতো তার মৃত্যু-পাণ্ডুর মুখের শেষ জ্যোতি দেখলে –তারপর আস্তে আস্তে তার চোখের পাতা বন্ধ করে দিলে।

প্রভাতের ফুল দুপুরের আগেই ঝরে পড়ল।

মেজোবউ আর চুপ করে থাকতে পারল না। চিৎকার করে কেঁদে উঠল, “মাগো, তোমরা ওঠো, সেজ নেই…”

প্রভাতের আকাশ-বাতাস হাহাকার করে উঠল – নেই – নেই – নেই!

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish