মৃত্যুক্ষুধা – ১৪

Any SubtitleJune 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ১৪

পরদিন সকালে কেউ উঠবার আগেই মেজোবউ তার ছেলেমেয়েকে নিয় মিস জোন্সের কাছে চলে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বড়োবউকে চুপি চুপি বলে গেল, “শাশুড়ি বিশেষ পীড়াপীড়ি করলে বাপের বাড়ি গেছি বোলো!” বড়োবউ ক্ষুণ্ণ হয়ে চুপ করে রইল। মেজোবউ এতটা বাড়াবাড়ি তার ভালো লাগছিল না। তবু সে মেজোবউকে একটু বেশিরকম ভালোবাসে বলেই কিছু না বলে অভিমানে গুম হয়ে রইল। কত বড়ো দুঃখে পড়ে মেজোবউ আজ মিস-বাবাদের কাছে সরে যাচ্ছে, তাও তার অজানা ছিল না। তাই আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছে সে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়েই রইল।

দিনকয়েক আগে থেকে তার শাশুড়িও কাঠুরে-পাড়ার সাব-ডেপুটি সাহেবের বাড়িতে চাকুরি নিয়েছিল, তাই সকালে উঠেই সেও চলে গেল, কারুর খোঁজখবর নেওয়ার আর গরজ করলে না। নইলে সকালেই হয়তো একটা কাণ্ড বেধে যেত!

পাড়ার অল্প দূরেই রোম্যান ক্যাথলিক গির্জা-ঘর। মেজোবউ গির্জার দ্বারে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তখন গির্জার ভিতরে খ্রিস্টের স্তব-গান গীত হচ্ছিল সববেত নারী-কণ্ঠে। গানের কথা সে বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছিল না, তার কাছে অপূর্ব মিষ্টি লাগছিল শুধু তার সুর আর প্রকাণ্ড হলে প্রতিধ্বনিত অর্গ্যানের গম্ভীর মধুর আওয়াজ। তার মন শ্রদ্ধায়, খুশিতে ভরে উঠছিল।

হঠাৎ তার মনে পড়ল তারই বাড়ির পাশের মসজিদের আজান-ধ্বনি। তার মন কী এক অব্যক্ত বেদনায় কেবলই আলোড়িত হয়ে উঠতে লাগল। তার মন যেন কেবলই শাসাতে লাগল, সে পাপ করছে – অতি বড়ো অন্যায় করছে, এর ক্ষমা নাই, এর ফল ভীষণ, তাকে অনন্তকালের জন্য…।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কার ছোঁয়ায় চমকে উঠে দেখল, মিস জোন্স মধুর হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে পিছনে দাঁড়িয়ে। মেজোবউকে ইঙ্গিতে পিছনে আসতে বলে মিস জোন্স গির্জার পাশের বাড়ির একটা কামরায় গিয়ে ঢুকল। মেজোবউ কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল দেখে মিস জোন্স ভিতর হতে বললে, ‘ভিটরে এসো।’মেজোবউ স-সংকোচে ভিতর গিয়ে দেখলে, সামনের টেবিলে চা-বিস্কুট প্রভৃতি খাবার। মিস জোন্স মেজোবউকে তার বিছানার জোর করে বসিয়ে বললে, “একটু চা খাও আমার সাটে, টারপর কঠা হবে।”

মেজোবউ কিছুতেই রাজি হয় না খেতে। অনেক পীড়াপীড়ির পর বললে, “মিস-বাবা আমাদের জাত যায় তোমাদের সাথে খেলে।” মিস জোন্স চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ে বললে, “ও ঘড! আমিও টো টা জানটুম।” বলে মুখ ম্লান করে কী যেন ভাবতে লাগল। তারপর বললে, “কিন্টু টোমাডের মুসলমান ধর্মের অনেক কিছু আমি জানি, টাটে কারুর সঙ্গে খেটে নিষেড নেই।” মেজোবউ হেসে বলল, “তা তো আমি জানি না, আমাদের মউলবি সায়েব আর মোড়ল তো অনেক জরিমানা করেছে খেরেস্তানদের ছোঁয়া খাওয়ার জন্যে।”

মেম সায়েব আর কিছু না বলে মেজোবউয়ের ছেলেমেয়ে দুটিকে কাছে টেনে নিয়ে বিস্কুট হাতে দিয়ে বললে, “এদের আমি চা খাওয়ালে ডোষ হবে না টো?” মেজো-বু হেসে বললে, ‘হবে।’ মেম সাহেব এইবার একটু জোরের সঙ্গে বললে, “নিশ্চয় হবে না। ওরা এখনও মুসলমান-ক্রিশ্চান কিছু নয় – ওরা শিশু।”

মেজোবউ চুপ করে রইল। সে তখন অন্য কথা ভাবছিল।

ক্ষুধার্ত শিশু বিস্কুট হাতে করে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মেজোবউ অস্ফুটস্বরে বলল, “খা।”

ছেলেমেয়েদের চা খাওয়া হলে মিস জোন্স নিজে চা খেয়ে বললে, “টোমায় জোর করে খাওয়াব না। টবে টুমি কিছু না খেয়ে অমনি রইলে। যাক, টোমাকে ডাকব কী বলে? টোমার নাম টো একটা আছে।”

মেজোবউ হেসে বললে, “নাম একটা ছিল হয়তো বিয়ের আগে। তা এখন ভুলে গিয়েছি। এখন আমি ‘মেজোবউ’।”

মিস জোন্স হেসে বললে, “আচ্ছা, আমি টোমায় মেজোবউই বলব।”

বলেই মিস জোন্স কী ভাবলে অনেকক্ষণ ধরে। তারপর আস্তে আস্তে বললে, “ডেখ মেজোবউ, আমি টোমায় ভালোবেসেছি। কেন টোমায় এট ভালো লাগে জানি না। আমি টোমাকে আপন সিস্টারে মটো করে লেখাপড়া শেখাব।”

মেজোবউয়ের চোখ জলে টলমল করে উঠল।

প্রায় এগারোটার সময় যখন সে ছেলেমেয়ের হাত ধরে বাড়ি ঢুকল আবার এসে, তখন তার শাশুড়ি শিলাবৃষ্টির মেঘের মতো মুখ করে রান্নাঘরের সামনে বসে বোধহয় মেজোবউয়েরই প্রতীক্ষা করছিল।

মেজোবউ কিছু না বলে সোজা ঘরে ঢুকল গিয়ে। শুধু তার খোকা দৌড়ে তার দাদির কোলে উঠে বললে, “বল তো দিদি, কোথায় গিয়েছিলুম।” ভিতর থেকে মেজোবউ চিৎকার করে উঠল, “খোকা, এদিকে আয়!” ছেলে ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে চলে গেল। শাশুড়িও এইবার শতধারে ফেটে পড়ল। ঝড়, বজ্র ও শিলাবৃষ্টির মতোই বেগে চিৎকার, কান্না ও গালি চলতে লাগল। মেজোবউ চুপ করে শুনে যেতে লাগল।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish