মৃত্যুক্ষুধা – ২৪

Any SubtitleJune 28, 2023

[ad_1]

মৃত্যুক্ষুধা – ২৪

বরিশাল। বাংলার ভিনিস!

আঁকাবাঁকা লাল রাস্তা। শহরটিকে জড়িয়ে ধরে আছে ভুজ-বন্ধের মতো করে।

রাস্তার দু-ধারে ঝাউগাছের সারি। তারই পাশে নদী। টলমল টলমল করছে – বোম্বাই শাড়ি-পরা ভরা-যৌবন বধূর পথ-চলার মতো। যত না চলে, অঙ্গ দোলে তার চেয়ে অনেক বেশি।

নদীর ওপারে ধানের খেত! তারই ওপারে নারিকেল-সুপারি কুঞ্জঘেরা সবুজ গ্রাম, শান্ত নিশ্চুপ। সবুজ শাড়ি-পরা বাসর-ঘরের ভয়-পাওয়া ছোট্ট কনে-বউটির মতো।

এক আকাশ হতে আর-আকাশে কার অনুনয় সঞ্চরণ করে ফিরছে, “বউ কথা কও। কথা কও।”

আঁধারের চাঁদর মুড়ি দিয়ে তখনও রাত্রি অভিসারে বেরোয়নি। তখনও বুঝি তার সান্ধ্য প্রসাধন শেষ হয়নি। শঙ্কায় হাতের আলতার শিশি সাঁঝের আকাশে গড়িয়ে পড়েছে। পায়ের চেয়ে আকাশটাই রেঙে উঠেছে বেশি। মেঘের কালো খোঁপায় তৃতীয়া চাঁদের গোড়ে মালাটা জড়াতে গিয়ে বেঁকে গেছে। উঠোনময় তারার ফুল ছড়ানো।

তিন-চারটি বাঙালি মেয়ে কালাপেড়ে শাড়ি পরা, বাঁকা সিঁথি, ‘হিল-শু’ পায়ে দেওয়া, ওই রাস্তারই একটা ভগ্নপ্রায় পুলের উপর এসে বসল! মাথার ওপর ঝাউ শাখাগুলো প্রাণপণে বীজন করতে লাগল।

মাঝে মাঝে স্থানীয় জমিদারদের দু একটি মোটর-ফিটন যেতে যেতে মেয়েগুলির কাছে এসে গতি শ্লথ করে আবার চলে যেতে লাগল !

একটি মেয়ে ছাড়া আর সকলে মশগুল হয়ে গল্প জুড়ে দিল। একলা মেয়েটি একটু দূরে নেমে ঘাসের ওপর বসে একদৃষ্টে নদীর দিকে তাকিয়ে কী দেখছিল, জিজ্ঞাসা করলে হয়তো সে নিজেই বলতে পারত না।

অনেকক্ষণ গল্প-গুজবের পর দলের একটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “মেজোবউ, ওখানে একলাটি বসে কার কথা ভাবছ ভাই?”

মেজোবউ উত্তর দিল না।

মেয়েটি তখন উঠে গিয়ে তাকে একটু জোর করেই নিজেদের কাছে এনে বসিয়ে হেসে বললে, “জান, মেম-সায়েবের হুকুম তোমাকে চোখে চোখে রাখার! সরে পোড়ো না ভাই যেন, তাহলেই গেছি!”

মেজেবিউ ম্লান হাসি হেসে বললে, “না, সে ভয় নেই। আর সরে পড়লেও তো ওই নদীর জল ছাড়িয়ে বেশি দূর যাব না!”

অস্তমান তৃতীয়া চাঁদের মুখ ম্লান হয়ে উঠল তার হাসিতে। ঝাউগাছগুলো জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল।

যে মেয়েটি কথা বলছিল, তার নাম মিনতি।

মেজোবউয়ের প্রায় সমবয়সী। হিন্দুঘরের বউ ছিল সে। স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে খ্রিস্টান হয়ে ডাইভোর্স নিয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে বেড়ায়।

লেখাপড়া না-জানা মেয়েদের শিক্ষয়িত্রীরও কাজ করে।

এই মেয়েটিই মেজোবউয়ের একমাত্র বন্ধু। চোখের জল বদল-করা সই।

অন্য দুটি মেয়ের একজন বলে উঠল, “আচ্ছা ভাই, ওর মেজোবউ নাম কি আর ঘুচবে না?”

মেজেবিউ হেসে বললে, “তালগাছ না থাকলেও তালপুকুর নামটা কি বদলে যায় ?”

তেমনই জোর-করা হাসি! বুকের সলতে জ্বালিয়ে প্রদীপের আলো দেওয়ার মতো।

মিনতি মেজোবউকে আর কিছু বলবার অবসর না দিয়ে বলে উঠল, “তা ভাই, ওকে ওই নামে ডাকতেই আমার তো বেশ মিষ্টি লাগে। মনে হয় বেশ ঘরসংসার করে জা-ননদ মিলে সব আছি!”

অন্য মেয়েটি কৃত্রিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সুর করে গেয়ে উঠল, “হায় গৃহহীন, হায় গতিহারা!” তারপর কথায় একটু নুন-লঙ্কা মিশিয়ে বললে, “তা ভাই, তোমাদের ঘরের সাধ এখনও মেটেনি। তা দুধ খাওয়ার সাধই যদি জেগে থাকে, এ ঘোল খেয়ে খামোখা সর্দি করছ কেন?”

মেজেবিউ ঝালটুকু সয়ে নিয়ে বলল, “তা ভাই, মাথায় ঘোল ঢালার চেয়ে পেটে ঘোল ঢালা বরং সইবে!”

মেয়েটির গোপন দুর্বলতায় ঘা দিল গিয়ে এই ওস্তাদি মারটুকু। সে মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল, “মেজোবউ কথা শিখেছে দেখছি।”

মেজোবউ হেসে বললে, “তার চেয়ে বলো মানুষ হয়ে উঠলাম। আমরা কৃষ্ণনগরের মেয়ে ভাই, আমাদের কথা শিখতে হয় না! মায়ের পেট থেকেই কথা শিখে আসে আমাদের দেশের মেয়ে! কিন্তু তুমি রেগো না ভাই, আমি সত্যিই তোমাদের সঙ্গে মিশতে পারবার মতো হইনি। এই তো জোর করে ফ্যাশন করে শাড়ি পরাচ্ছ, বাঁকা সিঁথি কেটে দিচ্ছ, জুতোও মিলল কপালে, কিন্তু ও জুতো-শাড়ি দিয়েও কি তোমাদের মতো করে তুলতে পারলে! মেম-সায়েবদের জুতো মেম-সায়েবদের মাথায় থাক ভাই, আমি সাদা কাপড় পরে থাকতে পারলেই নিশ্বাস ফেলে বাঁচি !”

মেয়েটি একটু তীক্ষ্ম স্বরে বলে উঠল, “তাহলে এখানে এলে কেন?” তার এই খাপছাড়া প্রশ্নে সে নিজেই অপ্রতিভ হয়ে উঠল এবং সেই কারণেই ততোধিক রেগে গেল।

মেজোবউ তেমনই হাসিমুখে বলল, “আমি তো মেম-সায়েব হতে আসিনি ভাই, মানুষ হতেই এসেছিলুম। আলো-বাতাস প্রাণের বড়ো অভাব আমাদের সমাজে, তাই খাঁচার পাখির মতো শিকলি কেটে বেরিয়ে পড়েছিলুম। কিছু যে ভালো হয়নি আমার, তা বলব না। এখন যা শিখেছি, তাতে করে যেখানেই থাকি দুটো পেটের ভাত জোগাড় করবার অসুবিধে হবে না। কিন্তু কী করি, চিরজন্মের অভ্যেস, ওই জুতোটুতোগুলো পরলে মনে হয় পায়ে এ এক নতুন রকমের শিকলি পড়ল!”

মিনতি উঠে পড়ে বলল, “আচ্ছা, এইবার থেকে তুমি লুঙ্গি পরে থেকে, আমি বলে দেব গিয়ে! জুতোটুতো তোমার পোড়া কপালে সইবে না! এখন চলো, রাত্তির হয়ে যাচ্ছে।”

সকলে উঠে পড়ল। …

একটু না যেতেই প্যাঁকালের সঙ্গে দেখা হল। সে পাদরি সাহেবের সুপারিশের জোরে এখানে এসেই ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের পিয়োন পদ লাভ করেছে। এখন আর সে প্যাঁকালে নয়, তার নাম এখন জোসেফ ! ম্যাজিস্ট্রেট ডাকে, ‘জোসেফ আনন্দে প্যাঁকালে প্রায় কেঁদে ফেলে! ‘হুজুর’ বলে পড়ি কি মরি বলে ছুটে এসে আড়াই হাত লম্বা এক কুর্নিশ ঠোকে। শ্রীমতি কুর্শি ওরফে মিসেস প্যাঁকালে মিশনারি মেমদের ফাই-ফরমাশ খেটে দেয়, তার জন্য কুড়ি টাকা করে পায়। প্যাঁকালের পনেরো আর কুশির কুড়ি, মোট পঁয়ত্রিশ। দিব্যি হেসেখেলে সংসার চলে। কুর্শি প্যাকালেকে বড়ো একটা কেয়ার করে না, সে পাঁচ টাকা বেশি রোজগার করে। প্যাঁকালে কিছু বললে বলে, “আমি তোর খাই নাকি রে মিনসে? বেশি টকখাই টকখাই করিসনে।” বলে গরব করে চলে যায়।

প্যাঁকালে না খেয়েই আফিসে চলে যেতে চায়। বলে, “আমি ম্যাজিস্টারের পিয়োন। তোর মতন কত বিশ টাকা আমার কাছার তলায় ঝোলে। তোর মেমসায়েবকে শুধোয় কে!”

ঘরের বাইরে পা দিতেই কুর্শি কোমরে কাপড় জড়াতে জড়াতে বলে, “যা দিকিন দেখি !” বলেই খপ করে কোঁচাটা ধরে ফেলে। বলে, “আর এক পা এগুবি তো কেলেঙ্কারি বাধিয়ে দেব। কাপড় কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দেব!” বলেই কোঁচায় হ্যাঁচক টান দেয়।

প্যাঁকালে অসহায় অবস্থায় সেখানে বসে পড়ে, বলে, “ছেড়ে দে বলছি শালি ! নইলে দিলুম ধুমাধুম। … হেই কুর্শি, তোর পায়ে পড়ি। কেউ দেখতে পাবে এখুনি! আল্লার কিরে! জিশুখ্রিস্টের কিরে! মাইরি বলছি, আর কখনও কিছু বলব না।” বলেই নাকে কানে হাত দেয়।

কুর্শি কোঁচা ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বসে পড়ে। বলে, “চল, খাবি! খেয়ে তোর ম্যাজিস্টর খসমের কাছে গিয়ে রাগ দেখাস।”

বারো-আনা দিগম্বর প্যাঁকালে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে । তারপর খেয়েদেয়ে গুড়গুড় করে আফিসে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, “শালার মেয়ে-মানুষকে বিয়ে করার মতন গুখুরি কাজ আর নেই! তোকে যদি আর কখনও বিয়ে করি, আমার বাপের —”

কুর্শি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলে, “আসতে যদি পাঁচ মিনিট দেরি করবি, তাহলে আজ মেম-সায়েবদের কাছে গিয়ে শুয়ে থাকব।”

সেদিন রাস্তায় মেজোবউকে দেখে পূর্ব অভ্যাসমতো বলে উঠল, “মেজো-ভাবি, তোমাকেই খুঁজছি আমি।”

মেজেবিউ হেসে বললে, “কেন, কুর্শি কি আজও তাড়িয়ে দিয়েছে? আচ্ছা কুকুরে-ভালোবাসা তোমাদের যা-হোক!” বলেই পুরানো দিনের মতো মিষ্টি করে হাসে। অন্ধকার মেঘে বিজলির ক্ষণিক ছটা!

ওই হাসির মানে আগে প্যাঁকালে বুঝত না। কিন্তু এখন সে ঝানু হয়ে না গেলেও ডাঁশিয়ে উঠেছে, কাজেই ও হাসিতে, বেশ একটু যেন চমকে ওঠে। আঁধার রাতে বিজলি আর সাপ দুটোই চমকে দেয়।

প্যাঁকালে একটু থেমে তার পাশের মেয়েগুলোর দিকে আধা-কটাক্ষে চেয়ে নিয়ে বললে, “বাড়ির থেকে একটা চিঠি এসেছে, বিকেলে তুমি যদি একটু পড়ে দিয়ে আসো।”

মেজোবউকে কে যেন হঠাৎ চাবুক মারলে, চমকে উঠল সে! মুখ কেমন হয়ে গেল, আবছা আঁধারে ভালো দেখা গেল না। কিন্তু গলার স্বর শুনে মনে হল, কে যেন তার টুঁটি টিপে ধরেছে।

মেজেবউ শক্ত মেয়ে। তবু সে আজ আর সামলাতে পারল না। কম্পিত দীর্ঘ কণ্ঠে বলে উঠল, “চলো, এখনই তোমার বাড়ি চলো।”

প্যাঁকালে বলতে যাচ্ছিল, “আজ আর না-ই গেলে, কাল —”

তাঁকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে মেজেবিউ প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “না, না, এক্ষনি চলো !” বলেই সে প্রায় ছুটে প্যাঁকালের বাড়ির দিকে চলতে লাগল। তার সঙ্গে যে আর কেউ ছিল, বা তাদের কোনো কিছু বলবার দরকার, সেসব ভাববারও যেন অবসর ছিল না তার।

মিনতি প্যাঁকালেকে বলে দিল, সে যেন মেজোবউয়ের চিঠি পড়া হলেই তাকে সঙ্গে করে রেখে দিয়ে যায়।

দূরে থেকে দেখা গেল, মেজেবিউ তেমনই বেগে ছুটেছে ঘরের পথে।

হাউই যেমন বেগে আকাশে ওঠে, তেমনই বেগেই মাটির পৃথিবীতে ফিরে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish