মেয়্ ভুখা হুঁ

Any SubtitleJune 29, 2023

[ad_1]

মেয়্ ভুখা হুঁ

পাগলি মেয়ের কী খেয়াল উঠল, হঠাৎ দুপুর রাতে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ!’

মঙ্গল-ঘট গেল ভেঙ্গে, পুরনারীর হাতে শাঁখ আর বাজে না, শাঁখাও গেল টুটে। ভীত শিশু মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলে,

‘মা, ও কে কাঁদে?’

মা বললে, ‘চুপ কর, ও পাগলি, ও ভুলুনি, ছেলে ধরতে এসেছে।’

পাশে ছিল দস্যি ছেলে ঘুমিয়ে। সে লাফিয়ে উঠে বললে, ‘মা আমি দেখব পাগলিকে!’

মা ঠাস করে ছেলের গালে এক চড় কষিয়ে বললে, ‘দস্যি ছেলে! কথার ছিরি দেখ, ওই ডাইনি মাগিকে দেখবেন! শুয়ে থাক গিয়ে চুপটি করে। ষাট! ষাট!’

কিন্তু ছেলে আর ঘুমায় না। তার কাঁচা রক্তের পুলক-নাচা চঞ্চলতায় এক অভিনব সুর বাজতে লাগল।

‘মেয়্ ভুখা হুঁ।’

সে সুর – সে ক্রন্দন কাছে – আরও – আরও কাছে এসে যেন তারই দোরের পাশ দিয়ে কেঁদে গেল অনেক দূরের পুবের পানে। সে ক্রন্দন যত দূরে যায়, দস্যি ছেলের রক্ত ততই ছায়ানটের নৃত্য-হিন্দোলায় দুলতে থাকে, ভূমিকম্পের সময় সাগরদোলানির মতো। ছেলে দোর খুলে সেই ভুখারিনির কাঁদন লক্ষ করে ঝড়ের বেগে ছুটল। মা বার কতক ডেকে দোরে লুটিয়ে পড়ল। সে অসম্ভবকে দেখবে, সে ভয়কে জয় করবে।

এলোকেশে জীর্ণা শীর্ণা ক্ষুধাতুর মেয়ে কেঁদে চলেছে, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ।’ তার এক চোখে অশ্রু আর চোখে অগ্নি। দ্বারে দ্বারে ভুখারিনি কর হানে আর বলে, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ! মেয়্ ভুখা হুঁ!’

বুড়োর দল নাক সিঁটকিয়ে ভাল করে তাকিয়াটা আঁকড়ে ধরে, তরুণ যারা তারা চমকে বাইরে বেরিয়ে আসে, আর মা-রা ভয়ে বুকের মানিককে বুকে চেপে ধরে।

স্ত্রী ঘুমের মাঝে স্বামীর ভুজ-বন্ধন ছাড়িয়ে হঠাৎ বাতায়ন খুলে ভেজা-গলায় শুধোয়, কে এমন করে কেঁদে যায়? এমন ঝড়-বাদলের নিশীথে স্বামী স্ত্রীকে আরও জোরে বুকে চেপে ধরে ভীত জড়িত কণ্ঠে বলে, ‘আহা, যেতে দাও না –’

ভুখারিনির পেছনে দস্যি ছেলের দলটা বেশ দল-পুরু হয়ে উঠল। তারা সেই ঝঞ্ঝারাতের উদাসিনীকে ঘিরে উদ্দাম চঞ্চল আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,

‘তুমি কি চাও ভুখারিনি, – অন্ন?’

উদাসিনী ছলছল চোখে আর এক দোরে কর হেনে কেঁদে ওঠে, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ।’

‘অন্ন চাও না? তবে কী চাও, – বস্ত্র?’

এবার কণ্ঠস্বরে আরও কান্না আরও তিক্ততা ফুটে ওঠে, – ‘মেয়্ ভুখা হুঁ!’

উদাসিনী রাজপুরীর প্রান্তে এসে পড়ল।

অধীর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে দস্যি ছেলের দল চিৎকার করে উঠল, “বল বেটি, কী চাস, নইলে তোর একদিন কী আমাদের একদিন, – কী চাস তুই? আশ্রয়?”

ভুখারিনি কিন্তু কথাও কয় না, ফিরেও তাকায় না। একটা একটানা বেদনা-ক্রন্দন-ধ্বনি তার আর্তকণ্ঠে বারবার গুমরে ওঠে –‘মেয়্ ভুখা হুঁ!’

দস্যি ছেলেগুলো এবার সত্যি সত্যিই খেপে উঠল। তাদের কৃপাণ একবার কোষমুক্ত হয়ে আবার কোষবদ্ধ হল। এ যে নারী – মা।

কিন্তু রক্ত তাদের তখন অগ্নিগিরি-গর্ভের বহ্নি-সিন্ধুর মতো গর্জন করে উঠেছে, তাদের নিশ্বাসে নিশ্বাসে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। আর পারে না, সব বুঝি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবার।

উদাসিনী এক গভীর অরণ্যের প্রান্তে এসে ছিন্ন-কণ্ঠ কপোতিনীর মতো আর্তস্বরে কেঁদে উঠল, – ‘মেয়্ ভুখা হুঁ!’

ঝঞ্ঝা যেন মুখে চাবুক খেয়ে হঠাৎ থেমে গেল। বনের দোলা, নদীর ঢেউ, বৃষ্টির মাতামাতি সমস্ত তার বেদনায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল। দিগন্ত-কোল থেকে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ রক্ত-আঁখি মেলে বেরিয়ে এল। বনের শ্বাপদকুল উদাসিনীর পায়ের তলায় মাথা গুঁজে শুয়ে পড়ল। নিস্তব্ধ – নিঝঝুম।

সে কী অকরুণ নিস্তব্ধতা। কানের কাছে কোন্ না-শোনা সুরের অগ্নিঝংকার যেন অবিরাম করাত চলার মতো শব্দ করতে লাগল – ঝিম ঝিম ঝিম-ম্।

সেই সুর উচ্চ হতে উচ্চতর হয়ে শেষে খাদের দিকে নামতে লাগল।

এইবার যেন, ‘বাজে রে বাজে ডমরু বাজে – হৃদয় মাঝে, ডমরু বাজে।’

এই কি বিশ্ব ঘোরার প্রণব নিনাদ? এক সাথে তিনটা উল্কা আকাশ ফুঁড়ে ধরণির বুকে এসে পড়ল। যে যেন খ্যাপা ভোলানাথের ছেঁড়া ত্রি-শূল, অথবা তাঁরই ত্রি-নয়ন হতে ঝরে পড়া তিন ফোঁটা অগ্নি-অশ্রু।

দুষ্ট মেয়ে গঙ্গা কলকল কলকল করে হেসে উঠে সব নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলে। দিগচক্র-রেখায়-রেখায় বনানীপুঞ্জ দুলে দুলে উঠল, সে যেন উলসিত শিবের জটাচাঞ্চল্য।

পাগলি আবার কেঁদে উঠল, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ!’

দস্যি ছেলের দল এবার সত্যি সত্যিই অধৈর্য হয়ে উঠল। উদাসিনীর কেশাকর্ষণ করে উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘বল বেটি কী চাস?’

হরিত-বনের বুক চিরে বেরিয়ে এল রক্ত-কাপালিক। ভালে তার গাঢ় রক্তে আঁকা ‘অলক্ষণের তিলক-রেখা।’ বুকে তার পচা শবের গলিত দেহ। আকাশে খড়্গ উৎক্ষিপ্ত করে কাপালিক হেঁকে উঠল, – ‘বেটি রক্ত চায়!’

কে যেন একটা থাবা মেরে সূর্যটাকে নিবিয়ে দিলে।

দস্যি ছেলেরা হঠাৎ তাকিয়ে দেখে কোথাও কিছু নেই। শুধু অনন্ত প্রসারিত শ্মশান, তার মাঝে পাগলি বেটি ছিন্নমস্তা হয়ে আপনার রুধির আপনি পান করছে আর চ্যাঁচাচ্ছে, ‘মেয়্ ভুখা হুঁ – ‘মেয়্ ভুখা হুঁ!’

তরুণের দল ভীম হুঙ্কার করে উঠল, ‘বেটি রক্ত চায়! বেটি রক্ত চায়!’

মহা উৎসব পড়ে গেল ছেলেদের মধ্যে – তারা যজ্ঞ করবে। এবার মায়ের পূজার বলি হল মায়ের ছেলেরাই।

শ্মশান আজ নিস্তব্ধ, জগৎ-সৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তে বিশ্ব যেমন নিস্পন্দ হয়ে গেল, তেমনি স্তব্ধাহত।

* * *

রক্ত-যজ্ঞের পরের দিন কৈলাসে জগদ্ধাত্রী অন্নপূর্ণা দশ হাতে করুণা, স্নেহ আর হাসি বিলাচ্ছে দেখলাম। বললুম, বেটি জগদ্ধাত্রীও বটে। কাল তার ছেলেরা বলি হয়ে বেটির ক্ষুধা মেটালে, আর আজ সে দিব্যি অন্নপূর্ণা সেজে আনন্দ বিলোচ্ছে।

একরাশ ফোটা শিউলি পুবের হাওয়ায় উড়ে এসে আমায় চুম্বন করে গেল। কেমন করুণ শান্তিতে মন যেন আমার কানায় কানায় ভরে উঠল।

ও হরি! দেখি কী, অন্নপূর্ণা বেটির ঘরের একপাশে তার ছিন্নমস্তা ভৈরবী মূর্তির মুখোশটা পড়ে রয়েছে। ভোলানাথ তো হেসেই অস্থির।

আরও দেখলুম কালকার রক্ত-যজ্ঞের আহুতি ওই দস্যি ছেলের সব কটাই জলজ্যান্ত বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যে-দশটা ছেলে নীলকণ্ঠ শিবের কাছে, তাদের কন্ঠ সব নীল। সে নীল দাগ তাদের টুঁটি টিপে মারার – ফাঁসির দাগ। আর যে-দলটা অন্নপূর্ণার ভাঁড়ার ঘরের পাশে জটলা করছে, তাদের কণ্ঠে লাল দাগ। ঘাতকের হানা খড়্গ-রক্ত প্রেয়সীর শরম-রঞ্জিত চুম্বনের মতো তাদের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে রয়েছে।

Leave a comment

Name *
Add a display name
Email *
Your email address will not be published

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

en_USEnglish